চোখের সামনে ভেসে ওঠে ওয়াটার কালারে আঁকা এক অপূর্ব ল্যান্ডস্কেপ। লম্বা লম্বা পাইনের আবছা সিল্যুয়েট। তার পাশ দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তার দুটি গভীর বাঁক। পাইনের মেঘজড়ানো মাথার ওপর দিয়ে মনাষ্ট্রির প্যাগোডা আকৃতির চূড়ার হালকা আউটলাইন। হঠাৎ সাদা হয়ে গেল ক্যানভাস। এক ঝলক কুয়াশায় ঢাকা পড়ল লাভার পথঘাট, পাহাড়, জঙ্গল।
বিকট গরমে মন পালাই পালাই, তাই ঢুকে পড়লাম লাভার সবুজ-ঘরে। যেন ন্যাচারাল এয়ার কন্ডিশনিং। কুয়াশায় ঘষা কাঁচের ওপর ভেসে ওঠে সারি সারি ক্রিসমাস-ট্রি। তার ওপরে সাদা বরফের ঢেউ, কত জানা-অজানা স্নো পিকস্। লাভা দার্জিলিং জেলার ছোট্ট পাহাড়ি জনপদ এবং নেওড়াভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের প্রবেশপথ। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ঘন্টা তিনেকের গাড়িপথ। বছরের যেকোনও সময় লাভা আসা যায়। তবে বর্ষায় খুব জোঁকের উপদ্রব, এই সময়টা এড়িয়ে আসাই ভাল। রাত্রিবাসের জন্য রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ বনদপ্তরের কটেজ ও লগ হাট। এছাড়াও বেশ কিছু প্রাইভেট হোটেলও রয়েছে।
আরামদায়ক ঠাণ্ডায় মিঠে রোদ পিঠে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম লাভার আনাচে কানাচে। পাহাড়ের কোলে দোল খাচ্ছে ছোট ছোট ঘরবাড়ি। বাড়ির সামনে ফুলে ভরা উঠোন, ধাপ চাষের হলুদ-সবুজ আলপনা দেওয়া ক্ষেত। আরও দূরে ঘন অরণ্যে ঢাকা পাহাড়ের গায়ে লেপটে আছে মেঘের দল। দিগন্তে বরফঢাকা পাহাড়চূড়ার উঁকিঝুঁকি। ঢুকে পড়লাম পথের ধারের এক চা দোকানে। গরম গরম মোমোর সাথে চায়ের কাপে চুমুক দেওয়া। চোখ চলে যায় দোকানের কালিমাখা জানালার বাইরে। মূল্যহীন জানালার কালো ফ্রেমে ধরা দেয় কোন বিখ্যাত শিল্পীর ছবি। দূর পাহাড়ের ঢালে পাহাড়ি বস্তি থেকে পাক খেয়ে ওঠে ধোঁয়ার কুন্ডলী। গভীর অরণ্যে উত্তরে হাওয়া পথ হারায়, পাতায় পাতায় শোঁ শোঁ শব্দ তোলে। কাছেই রয়েছে এক বৌদ্ধমন্দির, পোশাকি নাম লাভা মনাষ্ট্রি। যার আঙিনায় দাঁড়িয়ে লাভাকে পাহাড় ঘেরা এক রূপকথার দেশ বলে মনে হয়। মনাষ্ট্রির ভেতরে বুদ্ধমূর্তির অর্ধনিমীলিত চোখের সামনে দাঁড়িয়ে মন শান্ত ও স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে। আমাদের আস্তানা ফরেষ্ট বাংলোর দিকে পা বাড়াই। পথের দুপাশে প্রেয়ার ফ্ল্যাগের ডানায় ওড়ে “ওম মণি পদ্মে হুম্”।
লাভার অরণ্য প্রকৃতিকে আরও সচেতনভাবে চিনতে ও বুঝতে চলে এলাম হাঁটাপথে নেচার ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টারে। নেওড়াভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের অন্তর্গত বলে এখানে দেখা যায় বিভিন্ন প্রজাতির ফ্লোরা ও ফোনা। অরণ্য ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সম্বন্ধে বিভিন্ন তথ্য জানা হলেও চিন্তিত করল অরণ্যের হাল-হকিকত। কাঠের চোরাচালান, অবৈধ বন্যপ্রাণী শিকার এখানে নতুন নয়। বোধহয় প্রকৃত বন্যপ্রাণীর ভিড় এখন অরণ্যের চৌহদ্দির বাইরে।
ফরেষ্ট বাংলোর পাশ দিয়ে আঁকাবাঁকা চড়াইপথে পাইনের ছায়ার হাত ধরে চলে এলাম টিফিনদাড়া ভিউপয়েন্ট। চারিদিকে বিছিয়ে রয়েছে সবুজ অরণ্যের চাদর। দিগন্ত জুড়ে সারি সারি বরফঢাকা পাহাড়চূড়ার হাতছানি। লাভা থেকে ১০কিমি দূরে ছোট্ট গ্রাম কোলাখাম। সেখান থেকে আরও সাড়ে ৪কিমি দূরে গিয়ে কিছুটা হেঁটে ঘুরে আসা যায় ছাঙ্গে ফলস্। সে এক মায়াবী ঝর্ণা একাকী ঝরে গহন অরণ্যের গভীরে। লাভা থেকে প্রথমে জিপে তারপর পায়ে হেঁটে উঠে এলাম রচেলা টপ। চোখের সামনে বিছিয়ে রয়েছে নেওড়াভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের সবুজ কার্পেট। তার ওপরে পূর্ব হিমালয়ের বিভিন্ন বরফচূড়ার অপূর্ব কারুকাজ। লাভার অনতিদূরে রয়েছে আরও এক মনোরম পাহাড়ি জনপদ রিশপ। সেখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ ভোলার নয়। রিশপেও থাকার জন্য অনেকগুলো হোটেল, রিসর্ট রয়েছে। পাইনের জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ি পথ বেয়ে লাইট অ্যান্ড শেডের বিচিত্র খেলা দেখতে দেখতে পৌঁছে যাওয়া যায় আরও এক সুন্দর জনপদ লোলেগাঁও। তবে সে এক অন্য গল্প, শোনাবো অন্য কোনোদিন।
কিভাবে যাবেন: শিলিগুড়ি বা নিউ জলপাইগুড়ি থেকে গাড়ি বুকিং করে যাওয়া যায়।
কোথায় থাকবেন: লাভা, লোলেগাঁও, রিশপ, কোলাখাম সব জায়গাতেই হোটেল, রিসর্ট ইত্যাদি আছে। বনদপ্তরে কটেজে থাকার জন্য যোগাযোগ করতে পারেন এই ঠিকানায়:
পশ্চিমবঙ্গ বন উন্নয়ন নিগম,
৬এ, রাজা সুবোধ মল্লিক স্কোয়্যার,
আর্য ম্যানসন, ৭ম তল,
কলকাতা – ১৩
ফোন – ২২৩৭ ০০৬০/ ০০৬১
ছবি সৌজন্যে – কৌশিক ব্যানার্জী
Facebook Comments