গোসাবা পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেল৷ ক্লান্তিকর জলযাত্রা শেষ করে নৌকা থেকে নেমে বেশ আরাম লাগছে৷ একটু চা-টা খেয়েই আবার রওনা দিলাম পাখিরালার উদ্দেশ্যে৷ গোসাবা দ্বীপের অপর সীমানায় পাখিরালার অবস্থান৷
সূর্যাস্তের আকাশে মেঘের আলপনা, দু’পাশে ধানের ক্ষেত, ছোট ছোট কুঁড়েঘরের জীর্ণদশা, শিশু- কিশোরদের দৌরাত্ম্য দেখতে দেখতে পিচঢালা আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে সাইকেল ভ্যানে চেপে এগিয়ে চলি৷ প্রকৃতিতে বর্ষার প্রকট ছাপ, চারিদিকে সবুজের সমারোহ৷
পথে ভ্যানচালক শঙ্করদার সাথে গল্প জুড়ে দিলাম৷ আধ ঘণ্টার সফরে রোমাঞ্চকর সব কাহিনী ! শুনলাম বর্ষার সময়ে বাঘেরা বাঘিনীর সঙ্গে মিলনের আশায় বেরিয়ে পড়ে৷ সেইসময়ে লোকালয়েও চলে আসে ! খবরের কাগজের শিরোনাম হয় ! পাখিরালাতেও নাকি বাঘবাবাজি মাঝেমধ্যেই হানা দেন !
পাখিরালা পৌঁছে দেখি চারিদিক শুনশান৷ কোথাও কোন জনমনিষ্যি নেই৷ আমরা দু’জন আর ভ্যানচালক শঙ্করদা৷ নদীর তীরে কয়েকটা মাটির ঘর৷ এগুলো নাকি দোকানঘর, মরসুমে খোলা থাকে, এখন পর্যটক না থাকায় বন্ধ৷ তখন মানুষজনের কলরবে মুখরিত হয় পাখিরালার এই নদীকূল৷ সামনেই বিশাল মাতলা নদী, অপর তীরে সজনেখালি দ্বীপ৷ শঙ্করদা জানালেন, একটু হাঁটলেই একটা হোটেল রয়েছে, নাম কৃষ্ণকূঞ্জ৷ জানিয়েই তিনি বিদায় নিলেন৷ ততক্ষণে অন্ধকার নেমে এসেছে৷ দুরুদুরু বুকে এগিয়ে কৃষ্ণকূঞ্জ হোটেলের সামনে উপস্থিত হলাম৷ চারিদিক অন্ধকার, বিদ্যুতের কোন ব্যবস্থাই চালু হয়নি৷ টর্চের আলোয় দেখলাম হোটেলের সব ঘর বন্ধ, তালা ঝুলছে৷ ভয় আর দুশ্চিন্তা ক্রমশ গ্রাস করছে৷ শঙ্করদার থেকে নামটা জেনে নিয়েছিলাম, কেয়ারটেকার মৃণালদা’র নাম ধরে হাঁকডাক শুরু করলাম৷ বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পরেও কোন সাড়া মিললো না৷ বিপদের গন্ধে আমাদের কপালে তখন বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে৷ ভ্যানটাকেও ছেড়ে দেওয়াটা বোকামি হয়েছে মনে হচ্ছে৷ গোসাবা ফিরে যাওয়াটাও এখন অসম্ভব৷ পিছানোর পথ বন্ধ, সামনেও কোন উপায় দেখছি না৷ সত্যিই এ যেন ‘জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ’ এর মতো অবস্থা ! সার্থক সুন্দরবনের বিশেষণ ! হঠাৎ প্রায় দেবদূতের মতো আবির্ভূত হলেন রোগা রোগা চেহারার এক ভদ্রলোক৷ আমরা যেন প্রাণ ফিরে পেলাম ! কিন্তু কথা বলে নিরাশই হলাম, কারণ ইনি মৃণালদা নন৷ তবে তিনি জানালেন, একটু দূরে আরেকটা হোটেল তৈরির কাজ চলছে, ওখানেই তিনি মৃণালদাকে তিনি দেখেছেন৷ অন্ধকারের মধ্যেই পড়ি মরি করে সেদিকে দৌড়ে গেলাম৷ কথায় আছে না, ‘যেখানেই বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয় ! উফফ্ কারা যে এগুলো লিখেছিলেন ! তাঁরাও কি আমাদের মতো সুন্দরবনে এসে অসহায় অবস্থায় পড়েছিলেন ! কে জানে !
ডাকাডাকির পর অবশেষে মৃণালদার সাক্ষাত মিললো৷ কিন্তু তিনি আমাদের দেখে বাঘ দেখার মতই আশ্চর্য হলেন ! সব শুনেও নির্দয়ভাবে তিনি বললেন এই মুহূর্তে তাঁর হোটেলে আমাদের জায়গা দেওয়া সম্ভব নয় ! কারণ পর্যটক থাকার মতো ন্যূনতম আয়োজনটাও এই মুহূর্তে তাঁর হোটেলে নেই৷ আমরা প্রায় হাতেপায়ে ধরলাম, বললাম, রাতটুক থাকতে দিলেই চলবে৷ আমরা আর কিছু চাই না৷ মৃণালদা বললেন, হোটেলের রেস্তোরাঁ এখন বন্ধ, আমাদের দু’জনের জন্য আলাদা কোন খাবারের ব্যবস্থা তিনি করতে পারবেন না৷ আমরা বললাম, আমাদের জন্য আলাদা কিছু বন্দোবস্তের দরকার নেই, তিনি রাত্রে নিজের জন্য যা যা রান্না করবেন, সেটা খেতেই আমরা প্রস্তুত ! আমাদের অসহায়তা দেখে খানিকটা নিমরাজি হয়েই তিনি আমাদের হোটেলের দিকে নিয়ে চললেন….
(এরপর শেষ পর্বে)
ছবি সৌজন্যে – কৌশিক ব্যানার্জী
Facebook Comments