অবশেষে মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই পাওয়া গেল৷ দীর্ঘদিন অব্যবহৃত স্টোররুমের মতো ঘর, বিছানাপত্র কিচ্ছু নেই, শুধু তক্তপোষ৷ মন্দের ভাল, বলা যায় বাঘের পেটে যাবার থেকে ভাল ! একটু ফ্রেশ হয়েই বাইরে এলাম৷ কেয়ারটেকার মৃণালদাকে আরেকটু ‘তেল’ দিলে রান্নার মেনটা একটু ভাল হতেও পারে৷ চায়ের ফাঁকে আড্ডা দিয়ে বুঝলাম লোকটা মন্দ নয়৷ অনেক গল্পও শোনালেন৷ এলাকার মানুষেরা কিভাবে জঙ্গলের ওপর নির্ভরশীল তা উনি বেশ সহজেই বোঝালেন৷ জঙ্গলে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এলাকার মানুষ কিভাবে মধু সংগ্রহ করে, মাছ ধরতে যায় জেলের দল, বাঘসুমারি কিভাবে হয় যতটা সম্ভব বোঝার চেষ্টা করলাম৷ এসব কাজ করতে গিয়ে যে কত দুর্ঘটনা ঘটে কান খাড়া করে শুনলাম৷ জানতে পারলাম গ্রামে রাতবিরেতে আচমকা বাঘের হানার ঘটনা৷ রান্নার ফাঁকে এসব শুনতে শুনতে মোহিত হয়ে গেছিলাম৷ মৃণালদাই জোর করলেন আশেপাশে একটু ঘুরে আসার জন্য৷ আমি আর মৈনাক দুজনেই মাতলা নদীর পারে গিয়ে বসলাম৷ দূরে নদীর অপরপ্রান্তে সজনেখালি ট্যুরিস্ট লজের সোলার আলোগুলো দপদপ করে জ্বলছে৷ পরিবেশ মায়াময় হলেও এতক্ষণ বাঘের গল্প শোনার পর বেশ গা ছমছম করছে৷ মৈনাক মনের আনন্দে গান ধরেছে কিন্তু আমি ইতিউতি নজর রেখে চলেছি ! যদি সৌভাগ্য কিংবা দূর্ভাগ্যবশত দক্ষিণ রায়ের দর্শন মিলে যায় ! বলা তো যায় না, কথায় আছে ‘সাপের লেখা আর বাঘের দেখা’! কিছুক্ষণ পরে হোটেলে ফিরে এলাম৷ ততক্ষণে আমাদের ডিনার তৈরি৷ ভাত, ডাল, আলু ভাজা, বিভিন্ন সবজি দিয়ে একটা তরকারি আর ডিমের কারি৷ তোফা ! এতটা যে কল্পনাই করিনি ! খাবার ফাঁকেই মৃণালদাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কাল আমরা কোথায় ঘুরবো ?’
মৃণালদা বললেন, ‘সজনেখালি যাবার ফেরি পারাপার তো এখন বন্ধ, সিজনে চালু থাকে৷ দেখি আপনাদের ওখানে পৌঁছনোর বিকল্প কোন ব্যবস্থা করতে পারি কিনা !’
ওমা ! কি বলে দেখো ! এতদূর এসে সজনেখালিটাই যেতে পারবো না ! আমি আর মৈনাক মুখ চাওয়া- চাওয়ি করে বলি, ‘একটা ব্যবস্থা আপনাকে করতেই হবে !’
মৃণালদার সংক্ষিপ্ত জবাব, ‘দেখি !’
আমি জিজ্ঞেস করি, ‘আচ্ছা ওখানে গেলে কি বাঘ দেখতে পাবো ?’
প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিক হলেও বুঝলাম জিজ্ঞেস করাটা বড্ড বোকাবোকা হয়ে গেল !
মৃদু হেসে মৃণালদা বললেন, ‘সেটা আপনাদের কপাল !’
ঠিক করলাম সজনেখালি যেতে পারি আর না পারি, ভোর ভোর উঠতেই হবে৷ মৃণালদাকেই গুরুদায়িত্বটা দিলাম, ঘুম ভাঙানোর৷ তাড়াতাড়িই বিছানা থুড়ি তক্তপোষ নিলাম !
ভোরবেলা উঠে চা- টা খেয়েই বেরিয়ে পড়লাম৷ মৃণালদা নদী পারাপারের একটা উপায় বের করেছে৷ বাঁধ মেরামতির কাজে একটা ডিঙি নৌকা পাখিরালা আর সজনেখালির মধ্যে মাটি বহন করছে৷ সেটাই যেন আমাদের কাছে ময়ূরপঙ্খী ! তার ‘পাইলট’- এর নাম রহমত৷ গায়ে পলিমাটি মেখে শেষপর্যন্ত সজনেখালি পৌঁছলাম৷
গিয়ে দেখি মানুষের ঘোরাফেরার জন্য অনেকটা জায়গা মোটা লোহার জাল দিয়ে ঘেরা৷ অর্থাৎ জন্তুজানোয়াররাই আমাদের দেখতে আসবে ! দারুণ ব্যাপার ! বনদপ্তরে নামধাম লিখে অনুমতি পাওয়া গেল৷ রয়েছে বনবিবির মন্দির, ব্যাঘ্র মিউজিয়াম৷ মিউজিয়ামটা সত্যিই দেখার মতো৷ অনেক অজানা তথ্য সযত্নে রক্ষিত আছে৷
সজনেখালি ট্যুরিস্ট লজে অনেকেই রাত্রিবাস করেন, তবে ব্যয়বহুল৷ এই মুহূর্তে কোন ট্যুরিস্ট নেই, মেরামতির কাজ চলছে৷ সেখানকার রেস্তোরাঁয় চা খেতে গিয়ে কি বিপত্তি ! এককাপ চায়ের দাম ছ’টাকা ! ভাবলাম এককাপ অর্ডার দিই, দু’জনে ভাগ করে খাবো ! বলতেই রেস্তোরাঁর কর্মী আমাদের আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বললেন, ‘এককাপ চায়ের অর্ডার নেওয়া যাবে না’৷ নাচার হয়ে চা খাবার বাসনা ত্যাগ করলাম৷ খিদেও পেয়েছে, সকাল থেকে চা- বিস্কুট ছাড়া কিছু জোটেনি৷ আর এখানে খাবারের যা দাম আমাদের কেনার সামর্থ নেই৷ নিরুপায় হয়ে আমাদের নিয়ে আসা রহমত চাচাকেই কিছু টাকা দিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করলাম৷ উনি পাখিরালা গিয়ে আমাদের জন্য কিছু খাবার কিনে নিয়ে আসবেন৷
এরপর প্রায় তিনতলা সমান উঁচু ওয়াচ টাওয়ারে উঠে বসলাম৷ চারিদিকে যতদূর দেখা যায় সুন্দরী, গরান, গেঁওয়া, হেতাল গাছের বিশাল জঙ্গল৷ তাদের শ্বাসমূলগুলো বেরিয়ে আছে৷ বন্যজন্তুদের দেখার জন্য জঙ্গল সাফ করে কয়েকটা রাস্তা করা আছে৷ রাস্তায় চলাফেরা করলে যাতে তাদের দেখতে পাওয়া যায়৷ ঘেরা অঞ্চলের বাইরে রয়েছে মিষ্টি জলের পুকুর৷ বন্যজন্তুরা জলপান করতে এলে দর্শন মেলে৷ রয়েছে কুমির ও কচ্ছপ প্রজনন কেন্দ্র৷ সামনের গাছে কয়েকটা বানরের বাঁদরামি দেখা গেল৷ নিজেদের মধ্যে খুনসুটিতে মত্ত৷ বিভিন্ন দিক থেকে ভেসে আসছে নানান পাখির ডাক৷ মাঝেমাঝে কাছে এসে আবার উড়ে যাচ্ছে অদৃশ্য ঠিকানায়৷
অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলেও রহমত চাচার পাত্তা নেই৷ এদিকে আমাদের পেটে ছুঁচোর ডন৷ ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হল৷ দূরের জঙ্গলের পথ এখন অস্পষ্ট৷ হঠাৎ দূরের রাস্তায় কোন একটা জন্তুর উপস্থিতি নজরে এল৷ আমি আর মৈনাক সাগ্রহে, অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম৷ গাছেগাছে বানরের দলের দাপাদাপি, লম্ফঝম্ফ৷ পাখির ঝাঁকের সশব্দে উড়ে বেড়ানো৷ মনে হল হরিণ বুঝি ! চোখ কচলে নিলাম, দেখলাম, হ্যাঁ বাঘই তো ! রয়েল বেঙ্গল টাইগার ! বিস্ময়ে, উত্তেজনায়, শিহরণে আমরা দু’জনেই তখন বাকহারা ! স্বপ্ন নাকি সত্যি, বিশ্বাসই হচ্ছিল না ! গজেন্দ্রগমনে বাঘ এগিয়ে আসছে৷ মিষ্টি জলের পুকুরের কাছে এসে তিনি ডানহাতি রাস্তা ধরলেন৷ তারপর চোখের আড়ালে চলে গেলেন৷ উঁচু বিল্ডিংয়ে আগুন ধরলে প্রাণপণে যেমন মানুষ দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে, তারচেয়েও বেশি বেগে আমরা ওয়াচ টাওয়ার থেকে নেমে এলাম ! বৃষ্টির বেগকে তোয়াক্কা না করে কাঁটাতারের বেড়ার কাছে দৌড়ে গেলাম৷ কিন্তু না ! আর তিনি দেখা দিলেন না৷ বনদপ্তরের কর্মীদের কাছেও শুনলাম ব্যাঘ্রদর্শনের কথা৷ প্রায় মাস তিনেক পর এই অঞ্চলে বাঘের দেখা মিলল৷ ততক্ষণে রহমত চাচাও আমাদের ব্রেকফাস্ট নিয়ে হাজির৷ শুনবেন কি ?
মুড়ি আর বাতাসা !
ছবি সৌজন্যে – কৌশিক ব্যানার্জী
Facebook Comments