তৃতীয় পর্ব
ভোরবেলা উঠে দেওনিঙ্গালি ধাপ থেকে মনভোলানো সূর্যোদয়ের দৃশ্য দেখলাম। এই প্রথম কাঞ্চনজঙ্ঘার মুখদর্শন পাওয়া গেল। সূর্যোদয়ের সোনালী আলোয় রঙের ছটা দেখতে দেখতে সকলে তৈরি হয়ে নিলাম। আজ আমাদের গন্তব্য ১১কিমি দূরে অবস্থিত থুলোধাপ। ব্রেকফাস্ট সেরে রওনা দিলাম। একটানা চড়াই বেয়ে অনেকটা উঠে আসি। কাঁটাঝোপের জঙ্গল মাড়িয়ে ভুজ হয়ে পাহাড়ের ঢালে একটা উন্মুক্ত জায়গায় পৌঁছে যাই। ছোট্ট ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড। গাইড জানায় জায়গার নাম জড়িবুটি। অনেক ট্রেকিং দল দেওনিঙ্গালি ধাপে টেন্ট পিচ না করে এখানে রাত্রিবাস করেন। সেক্ষেত্রে সিঙ্গালিলা পাস্ পৌঁছাতে একদিন কম সময় লাগে। ট্রেক শেষ করতেও একদিন কম লাগে। জড়িবুটি থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা সহ অন্যান্য বরফশৃঙ্গগুলি দেখার সৌভাগ্য হয়। কিন্তু এখন বেলা গড়িয়েছে, তাই সেগুলো মেঘে ঢাকা। অসংখ্য পাখির কলকাকলিতে মুখরিত এই জড়িবুটি। মোবাইলের নেটওয়ার্ক পেয়ে সবাই যে যার বাড়িতে কথা বলে নিলাম। তারপর আবার পথচলা শুরু। কিছুটা চড়াই পেরিয়ে ছোট্ট একটা জলাশয় দেখা গেল। গাইড বললো এটা হাঁসপোখরি। পোখরি শব্দের অর্থ পুকুর। দেখতে দেখতে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলা। জঙ্গল ক্রমশ ঘন হয়ে ওঠে। ওঠা-নামা করতে করতে একটা নালার ধারে হাজির হই। ক্ষীণ জলধারা বয়ে চলেছে। জায়গাটার নাম আগুপানি। এরপর ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চড়াই ভেঙে আবার উৎরাই শুরু হয়। হঠাৎ একটা বিস্তীর্ণ বুগিয়ালে দূর থেকে আমাদের রংবেরঙের তাঁবুগুলো চোখে পড়ে। বুগিয়াল শব্দের অর্থ তৃণভূমি। পৌঁছে গেলাম শুকনো হলুদ ঘাসে আচ্ছাদিত প্রান্তরে। ঘাসের নিচে নরম মাটিতে পা ঢুকে যাচ্ছে। খুবই সন্তর্পণে হাঁটতে হলো, নাহলে জুতো কাদায় মাখামাখি হওয়ার সম্ভাবনা। এসে পড়েছি থুলোধাপ। উচ্চতা প্রায় ৯,৩০০ফুট। চারিদিকে বিক্ষিপ্তভাবে কাঁটাঝোপের জঙ্গল। একটা সরু জলধারা বুগিয়ালের মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে। এই জলই আমাদের আজকের রান্নায় আর তৃষ্ণা নিবারণে সহায় হবে। রাতে বেশ ঠাণ্ডা পড়লো, তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে স্লিপিং ব্যাগে আশ্রয় নিলাম।
পরদিন অন্ধকার থাকতেই গাইডের ডাকে ঘুম ভাঙে। টেন্টের বাইরে আসতেই সকলে মোহিত হয়ে যাই। সপারিষদ কাঞ্চনজঙ্ঘা যেন লাল আবিরে ঢাকা পড়েছে। রঙের খেলা দেখে সকলে আজকের গন্তব্যের জন্য তৈরি হয়ে নিলাম। আজকের পথ খুবই সংক্ষিপ্ত। গন্তব্য কালিঝারের দূরত্ব মাত্র ৪কিমি। গাইড জানালো আজ পুরোটা পথ চড়াই। সেইসঙ্গে রাস্তায় বরফ পড়ে থাকার সম্ভাবনা। বরফে হাঁটা রোমাঞ্চকর মনে হলেও সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার। নাহলে পিছলে গিয়ে বিপদ ঘটতে পারে। এসব শোনার ফাঁকেই ট্রেক শুরুর প্রস্তুতি নিয়ে নিই। ভাত, ফুলকপির কারি আর ডিমসিদ্ধ সহযোগে জলযোগ সেরে রওনা দিই। রডোডেনড্রন, বার্চ আর ফার গাছের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ সোজা উঠে গেছে। চড়াই ক্রমশ তীব্রতর হচ্ছে। একটু হাঁটলেই অবসন্ন শরীর বিশ্রাম নিতে চাইছে। কিছুটা গিয়ে প্রায় সমতল পথে পাহাড়ের মাথায় একটা উন্মুক্ত জায়গায় পৌঁছে যাই। জায়গাটার নাম আচালে। এখানেও অনেকে টেন্ট খাটিয়ে রাত্রিবাস করেন। ডানহাতি পথ উৎরাই বেয়ে উত্তরে গ্রামে মিশেছে। যাঁরা উত্তরে দিয়ে এই ট্রেক করেন তাঁরা এখানেই রাত্রিবাস করেন। এরপর রাস্তা একইরকম। গাইড বলেন, এই জায়গায় নাকি রেড পাণ্ডার অবাধ বিচরণ। যদিও আমাদের সৌভাগ্য হল না।
এখন আকাশ মেঘলা, কাঞ্চনজঙ্ঘা লুকিয়ে গেছে মেঘের আড়ালে। আচালেতে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবারও এগিয়ে চলা। প্রায় ঘন্টা তিনেক চড়াই বেয়ে আমরা উঠে আসি সবুজ ঘাসে ঢাকা এক বিস্তৃত পাহাড়ের ঢালে। জায়গাটার নাম খুব অদ্ভুত, ছিপছিপে। নাম যাই হোক ছিপছিপের সৌন্দর্য্যে সকলেই মুগ্ধ। আকাশ মেঘমুক্ত হতেই দিগন্তবিস্তৃত হিমালয়ের তুষারধবল শৃঙ্গগুলির নিঃশব্দ উপস্থিতি চাক্ষুস করা গেল। একেএকে পরিষ্কার হল কাঞ্চনজঙ্ঘা, পাণ্ডিম ছাড়াও মাউন্ট এভারেস্ট, মাকালু, লোৎসের দর্শন মিললো। ক্রমশ…..
ছবি সৌজন্যেঃ কৌশিক ব্যানার্জী
Facebook Comments