একসময় অভিনয় করেছেন চুটিয়ে। গত কয়েক বছর ধরে অভিনয় থেকে বিরতি নিয়ে শুরু করেন একটি কফি শপ। নাম দেন ‘বৈঠক’। বছর দুয়েকের মধ্যেই সফলতা না দেখতে বন্ধ হয়ে যায় ‘বৈঠক’। হার মানেননি স্বরলিপি। স্বামীকে সাথে নিয়ে আবার সে বছরেই নতুন উদ্যমে শুরু করেন ‘বৈঠক’ এর দ্বিতীয় সংস্করন, নাম তার ‘আবার বৈঠক’। চা খেতে খেতে বই পড়া, বা মন চাইলে একটু ক্যারাম বা দাবা’র বোর্ডে হাত ঝালিয়ে নেওয়ার দুর্দান্ত সেই কনসেপ্টকে নতুন ভাবে সাজিয়ে এনে ‘আবার বৈঠক’-এ হাজির করেছিলেন স্বরলিপি। বৃথা যায়নি তার চেষ্টা। শহুরে আড্ডাপ্রিয়দের বৈঠকের জন্য এখন একটা অন্যতম জায়গার নাম হল ‘আবার বৈঠক’। এর মাঝে গঙ্গা দিয়ে জল গড়িয়েছে অনেক। সন্তান হওয়ার কিছুদিন পর স্বামী’র সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় স্বরলিপির। তারপর থেকে নিজের সন্তান এবং ‘আবার বৈঠক’ দুটোকেই সফল ভাবে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন স্বরলিপি। ভালো কোন চরিত্র পেলে ইচ্ছে আছে আবার অভিনয়ে ফেরার। নিজে শর্ট ফিল্ম পরিচালনা করতে চান। এছাড়াও ‘আবার বৈঠক’ এর আরো কয়েকটি আউটলেট খোলার ইচ্ছে মাথায় ঘুরছে। নিজের কেরিয়ার থেকে শুরু করে ব্যবসা এবং মেয়েকে একার হাতে কিভাবে সামলাচ্ছেন জানাতেই গত রবিবাসরীয় দুপুরে
What’s New Life সাথে বৈঠকে বসলেন স্বরলিপি চ্যাটার্জী।
অভিনয়, ব্যবসা এবং মেয়ে সবকিছু একার হাতে কিভাবে সামলাচ্ছেন?
সত্যি কথা বলতে কি, মেয়েরা যে মা দুর্গা হতে পারে এটা আমি ভীষণ ভাবে বিশ্বাস করি। ম্যানেজমেন্টটা আমাদের থেকে ভালো কেউ বোঝে না। মানে কাকে কখন কি কাজ দিতে হবে, কাকে কখন খুশি করতে হবে, এটা আমি এতদিনে খুব ভালো করে বুঝে গিয়েছি। আসলে আমি এই মুহূর্তে আমি সেভাবে অভিনয় করছি না। অনেকদিন আগে শেষ সিরিয়াল করেছি। তার পরে রঞ্জন পালিতের একটা ছবিতে কাজ করি। সেটাও খুব অল্প সময়ের ছিল। এই মুহূর্তে আমি আপাতত ‘আবার বৈঠক’ এবং আমার মেয়েকে নিয়েই আছি মূলত। তবে অভিনয়ে আবার ফিরে যাওয়ার চেষ্টাও করছি। এছাড়া নিজে স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি পরিচালনা করার কথাও ভাবছি। ২০১২ সালে আমি এই ‘আবার বৈঠক’টা শুরু করি। তখন যদিও এটার নাম ছিল ‘বৈঠক’। তবে ‘বৈঠক’টা আমরা ঠিক সাফল্যের সাথে চালাতে পারিনি। ২০১৪ সালে এসে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। তবে আমি আশাবাদী ছিলাম যে আমি এটাকে আবার সফল করে তুলতে পারব। সেই বছরই অক্টোবর মাসে ‘আবার বৈঠক’ শুরু করি আমরা। তবে থেকে এটা খুব সফল ভাবেই চলছে। যদিও মাঝে একবার এটার জায়গা পরিবর্তন হয়েছে। শুরুর সময় আমার স্বামী আমার পাশে ছিলেন। আমরা দুজনে মিলেই প্রচন্ড পরিশ্রম করে ‘আবার বৈঠক’কে সাফল্যের পথে নিয়ে আসি। আসলে একটা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসে এই ধরনের একটি ভেঞ্চারকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া খুব একটা সহজ ছিল না। কলকাতার বুকে আমরাই প্রথম এই ধরনের কনসেপ্ট নিয়ে আসি। আসলে বাঙালির জীবনে ‘আড্ডা’ তো এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই আমরা চেয়েছিলাম এমন কিছু করতে যেখানে মানুষ সারাদিনের কাজের শেষে গিয়ে আড্ডা সহযোগে, চা খেতে পারবে, বই পড়তে পারবে, ক্যারাম খেলতে পারবে, দাবা খেলতে পারবে। সেটাই আমরা করেছি। কলেজ স্ট্রিটের পর আমাদের এখানেই সব থেকে বেশি বাংলা বইয়ের স্টক আছে। তারপর আমার সন্তান হওয়ার কিছুদিন পরেই আমার স্বামী আমাকে ছেড়ে চলে যায়। তারপর থেকে আমি একাই ‘আবার বৈঠক’ও আমার সন্তানকে এগিয়ে নিয়ে চলেছি।
নতুন কোন ড্রিম প্রজেক্ট মাথায় ঘুরছে?
নতুন প্রোজেক্ট তো মাথায় আছেই। আমি খুব তাড়াতাড়ি সল্টলেকে ‘আবার বৈঠক’ শুরু করতে চাই। এখনো পছন্দমতো জায়গা পাচ্ছি না। জায়গা পেয়ে গেলেই আমি ওখানে ‘আবার বৈঠক’ শুরু করে দেবো। এছাড়া আমি আবার অভিনয় জগতে ফিরতে চাইছি। আমি এখন ব্যবসার দিকটা খুব ভালো করে সামলে নিয়েছি। আর আমার মেয়েও খুব শান্ত। তাই এখন অভিনয়ে ফিরলে আর খুব একটা অসুবিধা হবে না।
টলিউডের এই মুহূর্তের কোন পরিচালকের সাথে আপনার কাজ করার ইচ্ছে রয়েছে?
সেরকম স্পেশাল কেউ নেই। এখনকার অনেক পরিচালককেই আমি চিনি। কাজও করেছি অনেকের সাথে। অনেক পরিচালকই টেলিভিশন থেকে উঠে এসেছেন। একই সময়ে কাআজ শুরু করেছি। তাই সেরকম কোন ব্যাপার নেই। অভিনয়ের ক্ষেত্রে প্রধান দিকতা হল চরিত্র। যার কাছে আমাকে দেওয়ার মতো ভালো চরিত্র থাকবে, যেটাতে আমি একেবারে ঠিকঠাক আমি সেই চরিত্রেই অভিনয় করব। আমি সমস্ত পরিচালকের সাথেই সব ধরনের কাজই করতে চাই। সবার কাজই আমার ভালো লাগে। প্রত্যেকের কাজেই একটা আলাদা নিজস্বতা আছে।
ব্যক্তিগত ভাবে কোন ধরনের সিনেমা দেখতে আপনি বেশি পছন্দ করেন?
কমার্শিয়াল সিনেমা প্রচণ্ড এন্টারটেনিং হয়। আমি যেহেতু ব্যবসা করি তাই আমাকে কর্পোরেট বলা যেতেই পারে। তাই সারাদিনের কাজের শেষে যখন আর মাথা কোন কাজ করেনা তখন এন্টারটেইনের জন্যই কমার্শিয়াল ছবি দেখতেই ভালো লাগে। কিন্তু একজন অভিনেত্রী হিসেবে যখন শান্ত মনে ছবি দেখতে বসি তখন আর্ট ফিল্মই বেশি ভালো লাগে। আর্ট ফিল্মে অনেক মেসেজ থাকে। যেগুলো মনকে খুব ছুঁয়ে যায়।
টলিউডের এখনকার কোন নায়কের সাথে কাজ করতে ইচ্ছে করে?
সত্যি কথা বলতে কি, কলকাতাতে সেরকম কেউ নেই। আমার প্রিয় অভিনেতা আর মাধবন। আমার খুব ইচ্ছে আমি মুম্বাইতে গিয়ে মাধবনের সাথে কাজ করি।
এতদিন যেই সমস্ত চরিত্রে অভিনয় করেছো, তার মধ্যে কোন চরিত্রটা এখনো মনে গেঁথে আছে?
‘বহ্নিশিখা’তে আমি একটা মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করতাম যেই মেয়েটা কথা বলতে পারত না। নিজের বাবাকে খুন করে এসেছে। মেয়েটা চোখ দিয়ে অভিনয় করত। ওই চরিত্রটা আমি আবার করতে চাই। এছাড়াও ‘অগ্নিপরিক্ষা’র চরিত্রটাও বেশ ভালো ছিল। কিন্তু ‘বহ্নিশিখা’ তে ওই মেয়ের চরিত্রটা অসাধারণ ছিল।
তোমার পছন্দের খাওয়া-দাওয়া?
আমি ভীষণ ফুডি। মিষ্টি খেতে আমি প্রচণ্ড ভালোবাসি। আর সেই জন্য বেশি জিম করতে হয়। না হলে ওজন কমানো যায়না। চা খেতে খুব ভালোবাসি। কফি একদম পছন্দ করি না। এছাড়া আমার নিজের কফি শপের স্যান্ডউইচ আমার খুব ভালো লাগে। আমাদের এখানেই একটা স্যালাড পাওয়া যেটা আমি প্রায় রোজই খাই। আর বিরিয়ানির প্রতি অসম্ভব দুর্বলতা আছে আমার। বিরিয়ানি দেখলেই আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনা।
যদি আপনাকে কোন সময় কিছু রান্না করতে বলা হয়, আপনী কি রান্না করবেন?
আমি একেবারেই রান্না করতে পারিনা। যেটুকু পারি সেটাও খুব বাজে খেতে হয়। আমার মনে হয় স্পাইসি সমস্ত খাবার বাইরেই তো কিনতে পাওয়া যায়। তাই আমি ওই বাজে, সেদ্ধ রান্নাগুলোই শিখেছি। মেয়ের রান্নাটা ভালোভাবেই করতে জানি। এছাড়া আমি আর কোন ভালো রান্না করতে পারি না।
‘আবার বৈঠক’ চালাতে গিয়ে নিজের মেয়েকে কতটা সময় দিতে পারছো?
আসলে আমি আমার সন্তানকে এমন ভাবে গড়ে তুলছি যাতে ওর কাউকে না দরকার হয়। ও সবার কাছেই থাকতে পারে। ওকে আমি মাঝে মাঝে এখানে ছেড়ে ৫-৬ ঘন্টা বাইরে চলে যাই। ওর কোন সমস্যা হয় না। আমার মা আর ভাইকে খুব ভালোবাসে। পাড়ার প্রতিবেশীদের কাছেও বেড়াতে চলে যায়। ওকে নিয়ে আমার এতটুকু সমস্যা নেই। ১৪ মাস বয়সেই ও নিজের প্রয়োজনীয় সমস্ত কথা বলতে পারে।
বৈঠক সমাপ্ত হল। স্বরলিপি তখন তৈরি হচ্ছে কোন এক ফ্যাশন কম্পিটিশনের অনুষ্ঠানে যাওয়ার। বৈঠক শেষে স্বরলিপির জীবনের গল্পে বারবার সমাজে নারীর ক্ষমতায়দের দিকটাই উঠে আসছিল।
ছবি- দেবাংশু মল্লিক
Facebook Comments