টলিউডে নতুন এসেই বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছেন অভিনেত্রী দেবলীনা কুমার। টলি পাড়ার নিউকামারদের মধ্যে এখন অন্যতম জনপ্রিয় নাম দেবলীনা। ইতিমধ্যেই কাজ করে ফেলেছেন ‘চল কুন্তল’ এবং ‘হামি’তে। কিছুদিন পরেই আসছে ‘আবার বসন্ত বিলাপ’। এছাড়াও আরো দুটি ছবির কাজ চলছে। এর পাশাপাশি চুটিয়ে চলছে ড্যান্স। সাথে আবার রয়েছে রবীন্দ্রভারতীতে প্রফেসরের চাকরি। ড্যান্স, অভিনয়, অধ্যাপনা সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে বেজায় ব্যস্ত দেবলীনা। এরই মধ্যে সময় বের করে এক সন্ধ্যেতে What’s New Life এর সাথে আড্ডাতে মাতলেন দেবলীনা। অভিনয় থেকে শুরু করে চাকরি, প্রথম কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে পছন্দের চরিত্র, বর্তমান বাংলা সিনেমার অবস্থা থেকে নিজের অসম্ভব ফুচকা প্রীতি, সব কিছু নিয়ে আমাদের সামনে অকপট দেবলীনা।
১. ড্যান্স, অভিনয় আর মডেলিং তিনটেই করছো। এর মধ্যে কোনটাতে তুমি নিজে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ কর?
দেবলীনা– এই তিনটের মধ্যে একটা যোগসূত্র রয়েছে। যেটা সুবিধার। তবে এই প্রশ্নটার উত্তর দেওয়াটা আমার পক্ষে খুব একটা কঠিন নয়। নাচ আমি এত বছর ধরে করে আসছি যে ওটা আমি এখন ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও করতে পারি। আবার মরে গিয়ে ভুত হয়েও করতে পারি। কিন্তু অভিনয়ের দিকটা একটু আলাদা। অভিনয় করতে গেলে এখনো ভাবতে হয় সেই চরিত্রটা নিয়ে। কিভাবে চরিত্রটা ফুটিয়ে তুলব। নাচ নিয়ে যে একেবারেই ভাবতে হয় না সেটা নয়। কিন্তু তুলনামূলক অনেক কম। এটাই বলব যে, অবশ্যই নাচের প্রতি আমার একটা আলাদ দুর্বলতা আছে। আমার যখন মন খারাপ থাকে তখন আমার যেটা করতে ভালোলাগে সেটা হল নাচ।
২. টলিপাড়ায় তোমার মিশুকে স্বভাবের জন্য বেশ খ্যাতি আছে। খুব সহজেই সকলের সাথে মিশে যেতে পারো তুমি। এই নিয়ে কোন একটা ঘটনা শেয়ার করো।
দেবলীনা– আমি সকলের সাথে এই জন্যই সহজে মিশে যেতে পারি কারণ আমি এত বেশ কথা বলি বলে। আমাকে যদি কেউ এক লাইনের কোন উত্তর জিজ্ঞেস করে আমি দশ লাইনে সেই উত্তর দিই সেটার জন্যই সবাই আমাকে মিশুকে ভাবে। কখনো আমার যদি মাথা গরম হয়েও যায় আমি সেটা প্রকাশ করিনা। সেই সময় কাউকে কিছু বলতে হলেও হেসেই বলি। তবে আমার সম্বন্ধে ইন্ডাস্ট্রিতে একটা বদনামও ঘোরাফেরা করে। অনেক সময় হয় সময়ের অভাবে অনেকের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে পারিনা। লোকে সেটাকে আমার অ্যাটিটিউড বলে মনে করে। এটা কিন্তু সত্যি নয়।
৩. এখনো পর্যন্ত তুমি যেই সমস্ত চরিত্র গুলিতে অভিনয় করেছো, তার মধ্যে কোন চরিত্রটা তোমার নিজের বেশি ভালো লাগে?
দেবলীনা -এখনো পর্যন্ত আমার যেই দুটি ছবি মুক্তি পেয়েছে ‘চল কুন্তল’ এবং ‘হামি’ দুটোতে আমার চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। একটাতে আমি এক বস্তির মেয়ের চরিত্র করেছি। অন্যটিতে আবার স্কুলের শিক্ষিকা। এরপরে আমার যেই ছবিটা আমার আসছে ‘আবার বসন্ত বিলাপ’ সেখানে আমি আবার এক কলেজ পড়ুয়া। এছাড়াও আমার আরও দুটি ছবির কাজ চলছে। যার মধ্যে একটাতে আমি একজন আদুরে রানীর চরিত্রে অভিনয় করছি। অন্যটিতে পুরো বিগড়ে যাওয়া একটি মেয়ের চরিত্রে। তাই আমি এটাই বলব, আমি এখনো পর্যন্ত যেসব চরিত্রে অভিনয় করেছি সেগুলো একটিও টাইপকাস্টেড হয়নি। প্রত্যেকটা চরিত্র করতেই আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। প্রত্যেকটা চরিত্রের মধ্যেই আমি আলাদা কিছু পেয়েছি।
৪. বড় বড় সমস্ত অভিনেতাদের সাথে কাজ করে কেমন লাগলো?
দেবলীনা– আমি প্রথমেই যেই দুই পরিচালকের হাতে পরেছিলাম তারা হল শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং নন্দিতা রায়। তারা দুজনেই প্রচণ্ড পারফেকশনিস্ট। আমি প্রথমে একটা শর্টফিল্ম করেছিলাম যেটা অনেকেই জানেননা। কেননা ওই ছবিটি শুধুমাত্র কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখানো হয়েছে। ছবিটির নাম ‘জয়ী’। এই ছবিতে আমি প্রচণ্ড শক্ত একটি মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। এই ছবিতে আমার বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। ‘চল কুন্তল’এ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথে কাজ করেছি, ‘হামি’ তে অনেক বড় সেলিব্রেটির সাথে কাজ করেছি। ‘আবার বসন্ত বিলাপ’এ পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মুনমুন সেনের সাথে কাজ করলাম। সত্যি কথা বলতে কি, আমার প্রথম প্রথম একটু অসুবিধা হতো। স্ক্রিপ্ট দেখে মনে হতো, কেন এত বড়। একটু কেটে দিলেই তো ভালো হয়। যদি বলতে গিয়ে ভুল করি। কিন্তু সবসময়য় সিনিয়ররা এতটা সহযোগিতা করেছে যে আমার কখনো নিজেকে নতুন বলে মনে হতনা। আমি নিজেকে খুব ভাগ্যবান বলে মনে করি যে আমি এদের সাথে কাজ করে আমার শুরু করতে পেরেছি।
৫. পুরনো অভিনেতাদের সাথে কাজ করতে গিয়ে কখনো ভয় পেয়েছিলে?
দেবলীনা– সত্যি কথা বলতে কি, আমার ভয় জিনিসটা নেই। আমার টেনশন হয় না। আমার মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্টের সময়েও আমি টেনশন করতাম না। ভাবতাম, ঠিকআছে কি আর হবে, মোটামুটি একটা নম্বর পেয়ে পাশ তো করেই যাবো। আমার বাবা-মা অবাক হতেন। কিন্তু ওই যে বললাম, টেনশনটা আমার আসে না। তাই শ্যুটিং এর সময়ে ভয়ে নার্ভাস হয়ে ভুলে যাওয়া এই জিনিসটা আমার সাথে হয়নি। হ্যাঁ তবে একজনকে আমি খুব ভয় পাই। সেটা হল শিবুদা (শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়)। কেননা শিবুদা সবসময়য় খুব ডিসিপ্লিনড, আমি যেটা একেবারেই না। কিন্তু শিবুদার সামনে ডিসিপ্লিনড থাকার চেষ্টা করি।
৬. এখন তো সারা বিশ্ব ফুটবল জ্বরে ভুগছে। তোমার প্রিয় দল বা প্রিয় খেলোয়াড় কে?
দেবলীনা– এইবার বিশ্বকাপের ম্যাচ গুলো দেখা হচ্ছে না। আগে বাবার সাথে খেলা দেখতাম। বাবা সবসময় ব্রাজিলকে সাপোর্ট করতেন। তাই আমিও বাবার দেখাদেখি ব্রাজিলকে সাপোর্ট করি। তবে ফুটবলারদের মধ্যে যদি বলতে হয় তাহলে তিনি হলেন মেসি। খেলার আমি বিশেষ কিছু বুঝি না। তবে মেসি দেখতে প্রচণ্ড কিউট। আর আমাদের কলকাতার ফুটবলের মধ্যে বাইচুংকে খুব ভালোলাগে।
৭. বাঙালি মানেই খাদ্যরসিক। তুমি খেতে কতটা ভালোবাসো?
দেবলীনা– খাদ্যরসিক তো অবশ্যই। ভাবি যে ডায়েটিং করবো। কিন্তু সেটা হয়ে ওঠে না। আসলে আমাদের এত অনুষ্ঠান লেগে থাকে যেমন পুজো, ঈদ, ক্রিসমাস, নিউ ইয়ার এই সমস্ত অনুষ্ঠানের সময় গুলোতে সব ডায়েটিং এর দফা রফা হয়ে যায়। তবে আমি যে খুব ফুডি সেটা বলবো না। তবে আমার কিছু প্রিয় খাবার আছে যেগুলো পেলে আমি খুব খুশি হয়ে যাই। তার মধ্যে অন্যতম হল ফুচকা। আমি অগুনিত ফুচকা খেতে পারি। যদি আমাকে কেউ ফুচকা অফার করে তাহলে আমি তার সাথে ঘুরতে যেতে রাজি। তবে কোন বড় রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে খাওয়ালে হবে না। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আমাকে যদি কেউ ফুচকা খাওয়াতে চায় তাহলে ‘আই অ্যাম রেডি টু গো’।
৮. ড্যান্স, অভিনয় একসাথে দুটোকে কিভাবে ম্যানেজ করছো?
দেবলীনা– সবাই জানে যে আমি অভিনয়, ড্যান্স করি। কিন্তু যেটা অনেকে জানে নে সেটা হল আমি অধ্যাপনাও করি। আমি রবীন্দ্রভারতীতে গেস্ট লেকচারারের চাকরিও করি। আমি নাচের থিওরি এবং প্র্যাক্টিকেল দুটোই পড়াই ওখানে। কিন্তু অভিনয়ের প্রতি একটা প্যাশন ও ভালোবাসা আমার ছোটোথেকেই ছিল। লোকে বলে যে হঠাৎ করে কিছু হয়ে গেল। কিন্তু আমার সাথে হঠাৎ করে কিছু হয়নি। আমি অনেকদিন থেকেই ভেবেছিলাম যে অভিনয়ে আসবো। অভিনয় শিখিনি কোনদিন। কিন্তু ইচ্ছেটা ছিল। দেখো, কষ্ট সেই জিনিসটার জন্যই করতে ভালো লাগে যেটাকে আমাকে ভালোবাসি। এখনো শ্যুটিং এর সময়ে কষ্ট হলেও শট দেওয়া হয়ে গেলে মনে একটা অদ্ভুত তৃপ্তি আসে।
৯. এই মুহূর্তে বাংলা সিনেমার অবস্থা নিয়ে কি বলবে?
দেবলীনা– বাংলা সিনেমা আগের অবস্থাটা থেকে ধীরে ধীরে বেরোচ্ছে। এখন যেই ধরনের সিনেমা হচ্ছে সেগুলো খুব ইন্টারেস্টিং। এখন বেশকিছু নতুন প্ল্যাটফর্ম এসেছে। যেমন ওয়েব সিরিজ। সেখানে মানুষ অনেক সহজেই সবকিছু দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু আমি তাও বলব, সিনেমার মধ্যে একটা আলাদা ব্যাপার আছে। সিনেমা বানানো বা সিনেমা দেখা দুটোরই মধ্যে একটা আলাদ অনুভূতি আছে। আমরা ইন্ডাস্ট্রির সবাই খুব চেষ্টা করে চলেছি দর্শকদের ভালো সিনেমা উপহার দেওয়ার। কিন্তু আমার মনে হয়, মানুষ যদি একটু বাংলা সিনেমা হলে এসে দেখেন তাহলে সেটা বাংলা সিনেমার পক্ষে খুব ভালো হয়।
১০. কলকাতায় বসবাসকারী অন্য ভাষার মানুষ জনের কাছে বাংলা সিনেমা কতটা পৌঁছতে পেরেছে বলে তোমার মনে হয়?
দেবলীনা– যারা সম্প্রতি এই শহরে এসেছেন তারা হয়তো বাংলা বোঝেন না। কিন্তু এই শহরে অনেক অবাঙালী মানুষজন আছেন যারা কয়েক জেনারেশন ধরে এখানে আছেন তারা কিন্তু বাংলা বোঝে। তবে আমি লক্ষ করেছি যে বাংলার কিছু পরিচালকের একটা বড় সংখ্যায় অবাঙালি ভক্ত রয়েছে। আমি শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সাথে কাজ করেছি বলেই এটা বলতে পারছি। অনেক সময় দেখেছি অবাঙালি দর্শকদের জন্য আলাদা করে ছবির স্পেশাল স্ক্রিনিং হচ্ছে। তখন বেশ ভালো লাগে।
১১. কলকাতায় এখন অনেক চিত্রপরিচালক স্বাধীনভাবে কাজ করছেন। তোমার কখনো ইচ্ছে হয়েছে স্বাধীন চিত্রপরিচালকদের সাথে কাজ করার?
দেবলীনা– অবশ্যই। এখন এত ভালো ভালো ছবি তৈরি হচ্ছে যেমন ‘সহজ পাঠের গপ্পো’, ‘রেনবো জেলি’। এই কাজ গুলি আমার অসম্ভব ভালো লাগে। খুবই ইন্টারেস্টিং চরিত্র থাকে এই ছবিগুলোতে। আমি এই ধরনের ছবিতে কাজ করবার জন্য মুখিয়ে আছি।
১২. সিনেমা ছাড়াও যদি তোমার কাছে লম্বা সময়ের ওয়েব সিরিজে অভিনয়ের সুযোগ আসে, তাহলে তুমি কি করবে ?
দেবলীনা– অভিনয়টা রোজ করতে পারলে ভালোই লাগে। কিন্তু ব্যপারটা হল যে, জিনিসটা একঘেয়ে হয়ে গেলে চলবে না। ওয়েব সিরিজের গল্পগুলো আমার ভীষণ ভালো লাগে। হয়তো গল্পের টানেই ওয়েব সিরিজে কাজ করবো। কিন্তু এই মুহুর্তে আমি সিরিয়াল করতে পারবো না। কেননা আমি একটা জায়গায় চাকরি করছি। সেখান থেকে তো আর দীর্ঘ সময়ের জন্য ছুটি নিতে পারি না। তবে ওয়েব সিরিজে আমি কাজ করতে আগ্রহী।
বর্তমান তরুণ সমাজ যখন একটা প্রফেশনেই নিজের খেই ধরে রাখতে পারছে না, সেখানে দেবলীনা সত্যিই একটা দৃষ্টান্ত। কোন কাজকে মন থেকে ভালোবাসলে সেটা যে, সমস্ত প্রতিকূলতা ভেঙে যে এগিয়ে যায় তার প্রমাণ দেবলীনা। What’s New Life-এর পক্ষ থেকেও দেবলীনার জন্য রইল অনেক শুভকামনা।
ছবি- দেবাংশু মল্লিক
Facebook Comments