কুম্ভ এক্সপ্রেস হেলতে দুলতে হরিদ্বারে যখন পৌঁছল ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে ন’টা। ঘন্টা তিরিশের বিরক্তিকর ট্রেনজার্নির অবসান। তড়িঘড়ি স্টেশনের কাছাকাছি এক ধর্মশালায় রাত্রিবাসের ব্যবস্থা হল। আমাদের এবারের গন্তব্য পঞ্চকেদারের অন্যতম এবং সহজগম্য কল্পেশ্বর৷ রাতটুকু কাটানোর জন্য ধর্মশালায় উঠে ফ্রেশ হয়ে বাইরের রেস্তরাঁয় ডিনার পর্ব সেরে সকলেই শেষ মুহূর্তের গোছগাছ করে তাড়াতাড়ি বিছানা নিলাম।
হরিদ্বারের ধর্মশালা থেকে খুব ভোরে বেরিয়ে পড়ে স্টেশন লাগোয়া বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছলাম। সবে অক্টোবরের শুরু, কিন্তু ঠাণ্ডায় বেশ গা শিরশিরে ভাব। আমাদের লক্ষ্য কল্পেশ্বর। বদ্রীনাথগামী বাসের সামনের দিকের চারটে সিট মিলে গেল। বাস ছাড়লো ঠিক সাড়ে পাঁচটায়। তখনও হরিদ্বারের ভাল করে ঘুম ভাঙেনি। বাসযাত্রীরা সকলেই স্থানীয়, সেই অর্থে ট্যুরিস্ট এবং বাঙালী কেউ নেই৷ ভোরের শুনশান রাস্তায় শীতমেখে বাসটা হুহু করে ছুটে চলল।
ঘন্টাখানেকের মধ্যে হৃষিকেশ পৌঁছে কিছু যাত্রী পেয়েই আবার দৌড়। আমরা যে পঞ্চপ্রয়াগের নাম শুনি, আজকের পথে তার বেশ কয়েকটির দেখা পাওয়া যাবে। প্রথমেই দেখা মিলল দেবপ্রয়াগ। যেখানে অলকানন্দা আর ভাগীরথী মিশেছে। ডানদিকের রাস্তা ভাগীরথীর উৎসের সন্ধানে চলে গেছে। আমাদের বাস অলকানন্দার সঙ্গে চলতে থাকে।
শ্রীনগর পেরিয়ে রুদ্রপ্রয়াগের কাছে একটা ধাবায় বাস দাঁড়িয়ে পড়ে। খাবার জন্য বিরতি। ব্রেকফাস্ট করে সকলে নিজের আসনে গিয়ে বসতেই বাস আবার চলতে শুরু করে। পাহাড়ের আঁকেবাঁকে বেয়ে চলে নদীর মতই। এরপর নন্দপ্রয়াগ, কর্ণপ্রয়াগ, চামোলি পেরিয়ে দুপুর সাড়ে তিনটেয় পৌঁছে যাই হেলাং। হরিদ্বার থেকে আসতে সময় লাগলো ঠিক দশ ঘন্টা। বাস ছেড়ে নেমে পড়তে হয়। এখান থেকে সোজাপথে আরও ১২কিমি গেলেই যোশীমঠ। যোশীমঠ হয়ে বাস বদ্রীনাথ পর্যন্ত যায়।
হেলাং নেমে একটাই ছোট্ট চায়ের দোকান চোখে পড়ে। চাউমিন, অমলেট আর চা সহযোগে উদরপূর্তি করে নিই। এখান থেকে বাঁদিকে আরও ১২কিমি পথ গাড়ির রাস্তা আছে। দাঁড়িয়ে থাকা টাটাসুমো সাতশো টাকায় ল্যয়ারি পৌঁছে দিতে রাজী হয়। লটবহর চাপিয়ে আমাদের গাড়ি সরু পিচঢালা পথে কল্পগঙ্গা নদীকে ডানহাতি রেখে এগিয়ে চলে। আধঘন্টায় ল্যয়ারি পৌঁছে যাই। গাড়ি এপর্যন্ত পৌঁছায়। এবার ট্রেকিং শুরু। আরও প্রায় ৩কিমি গেলে আজকের আশ্রয় দেবগ্রামে পৌঁছতে পারবো। ঘন্টাখানেক হেঁটে পৌঁছে যাই দেবগ্রাম। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। আশ্রয় নিই পথিক লজ-এ।
আজকের প্ল্যান দেবগ্রাম থেকে মাত্র কিলোমিটার দেড়েক গিয়ে পঞ্চম কেদার কল্পেশ্বর দেখে আবার ফিরে আসা। তারপর সারাটাদিন দেবগ্রাম ঘুরে দেখা। সামান্য হাঁটা, ফলে কোনও তাড়াহুড়ো নেই৷ গতকাল ক্লান্তিকর জার্নির শেষে জম্পেশ একটা ঘুম দিয়ে সকলেই দেরি করেই উঠলাম। কাল দেবগ্রামে পৌঁছতে সন্ধ্যা নেমে যাওয়ায় গ্রামটা ভাল করে চোখে পড়েনি। আজ উঠেই ইতিউতি ঘুরে দেখার পালা। আরামদায়ক ঠাণ্ডা। সকালের নরম রোদ সবুজ উপত্যকাজুড়ে আছড়ে পড়েছে। বেশ কয়েকঘর মানুষের বাস এই গ্রামে। নতুন পাকা ঘরের পাশাপাশি কিছু ঘরগুলোর গঠনশৈলীতে প্রথাগত গাড়োয়ালী ছোঁয়া। চোখে পড়ে স্থানীয়দের দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততা আর জিজ্ঞাসু দৃষ্টি। উচ্চতা কম হওয়ায় সারাবছর কল্পেশ্বর মন্দির খোলা থাকে। দর্শন করা যায়। যাত্রাপথ সুগম হওয়ায় প্রচুর দর্শনার্থী আসেন।
প্রাতঃরাশ করে আটটা নাগাদ আমরা কল্পেশ্বর দর্শনে বেরিয়ে পড়ি। চারপাশে ধাপচাষ, কোথাও ধান, কোথাও রামাদানা, কোথাও বা বিভিন্ন শাকসব্জির চাষ হয়েছে। পথের শোভা চলার গতিকে স্তব্ধ করে। হিমালয়ের কোলে সবুজ ঢালে রঙবেরঙের ঘরগুলো যেন আটকে রয়েছে। নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে কল্পগঙ্গার স্রোত। দূরে মেঘের ভেলার আড়ালে মাঝেমধ্যেই উঁকি দিচ্ছে নন্দাদেবীর শ্বেতশুভ্র শৃঙ্গ।
মনোরম, আরামদায়ক পথে হাঁটতে হাঁটতে আধঘন্টায় পৌঁছে যাই কল্পগঙ্গার তীরে। ওপরে দৃশ্যমান কল্পেশ্বরের অবস্থান। ২০১৩তে কেদারনাথের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় এখানকার লোহার সেতুটি ভেঙে যায়। নতুন সেতু বানানোর কাজ চলছে। খরস্রোতা কল্পগঙ্গা নদী পারাপারের জন্য অস্থায়ীভাবে কাঠের গুঁড়ি পাতা আছে। অতিক্রম করেই চড়াই ভেঙে কিছুটা ওপরে উঠেই কল্পেশ্বরের ছোট্ট তোরণ।
পুরাণ বর্ণিত পাচঁটি কেদারের পঞ্চম কেদার হল কল্পেশ্বর বা কল্পনাথ। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে স্বজন নিধন জনিত হত্যার পাপ থেকে পাণ্ডবদের সহজে মুক্তি দিতে অনিচ্ছুক পলায়নরত বৃষরূপী দেবাদিদেবের ধুম্র জটাজাল ভূমি ভেদ করে নির্গত হয় এই স্থানে। পাহাড়ের গুহায় বিরাটাকার পাথরখণ্ডের নিচে কংক্রিটের অপরিসর মন্দিরে বিরাজমান ত্রিকোণাকৃতি প্রস্তরীভুত স্বয়ংভু লিঙ্গ কল্পনাথ। অন্যান্য কেদারগুলির মত এই মন্দির দীপাবলি থেকে অক্ষয়তৃতীয়ার দিন পর্যন্ত বন্ধ থাকে না। একমাত্র কল্পেশ্বর মহাদেব স্বস্থানেই ভক্তের পুজো গ্রহণ করেন সারাটি বছর ধরে। স্থানীয় গ্রামীন নেগী উপাধিধারীদের দ্বারা পরম্পরাক্রমে পুজিত হোন তিনি। শিবরাত্রি ছাড়াও রাখীবন্ধন এখানকার অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। মন্দির দর্শন করে, পুজো দিয়ে মন এক প্রশান্তিতে ভরে ওঠে। একই পথে দেবগ্রামে নেমে আসি।
কিভাবে যাবেন: কলকাতা থেকে কুম্ভ বা উপাসনা বা দুন এক্সপ্রেসে হরিদ্বার। হরিদ্বার থেকে গাড়ি বুকিং করে অথবা বদ্রিনাথগামী বাসে হেলাং। হেলাং থেকে অন্য গাড়িতে ল্যয়ারি। সেখান থেকে কল্পেশ্বর অবধি প্রায় ৬কিমি ট্রেকিং।
কোথায় থাকবেন: হেলাংয়ে হোটেল আছে। কিম্বা দেবগ্রামে কয়েকটা হোমস্টে আছে। ‘পথিক লজ’-এ থাকতে চাইলে যোগাযোগ করতে পারেন রাজেন্দ্র সিং নেগীর সঙ্গে। মোবাইল নম্বর: ০৯৭৫৮৭০০২৬৩. কল্পেশ্বর যেতে গাইডের দরকার হয় না। তবুও কেউ সঙ্গে নিতে চাইলে যোগাযোগ করুন প্রদীপ নেগী: ০৭৫৭৯১১৬৭৩০
ছবি সৌজন্যে – কৌশিক ব্যানার্জী
Facebook Comments