গাড়োয়াল হিমালয়ের সর্বপরিচিত ট্রেক রুট হল পঞ্চকেদার। এগুলি হল কেদারনাথ, মদমহেশ্বর, তুঙ্গনাথ, রুদ্রনাথ এবং কল্পেশ্বর। দেবভূমি হিমালয়ের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে প্রকৃতি, পুরাণ আর ইতিহাসের নানা কাহিনী। পঞ্চ কেদারের মধ্যে লুকিয়ে আছে মহাভারতের এক গল্প। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে জয়লাভ করতে কৌরবদের হত্যা করলেন পঞ্চ পাণ্ডব। ভাই হত্যা ও ব্রাহ্মণ হত্যার মত গুরুতর পাপে বিদ্ধ হলেন। স্বজন হারানোর শোকে পাণ্ডব ভাইয়েরা নিজেদের মনের শান্তি হারিয়ে ফেললেন চিরতরে। রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব অন্যদের ছেড়ে পাঁচ ভাই বেড়িয়ে পড়লেন দেবাদিদেব মহাদেব-এর খোঁজে। উদ্দেশ্য তাঁর আশীর্বাদ নিয়ে কিছুটা হলেও মনের শান্তি ফিরে পাওয়া। প্রথমেই তাঁরা গেলেন শিবধাম কাশীতে। কারণ সেখানেই রয়েছে অসংখ্য শিব মন্দির। কিন্তু এরকম ভয়ঙ্কর পাপবিদ্ধ মানুষদের আশীর্বাদ তো দূরে থাক, দর্শন দিতেই গররাজী মহেশ্বর। কাশীতে শিবের দেখা না পেয়ে বিমর্ষ পঞ্চপাণ্ডব গেলেন গাড়োয়াল হিমালয়ে। সেখানে গুপ্তকাশীর কাছাকাছি তাঁরা দেখলেন প্রকাণ্ড এক ষাঁড় ঘুরে বেড়াচ্ছে। পঞ্চপাণ্ডবদের অন্যতম ভীম দর্শনমাত্র চিনে ফেললেন যে এই ষাঁড়ের ছদ্মবেশে লুকিয়ে আছেন স্বয়ং মহাদেব ! তড়িৎবেগে ছুটে গিয়ে ভীম ষাঁড়ের লেজ ও পেছনের পা জড়িয়ে ধরলেন। শিব তৎক্ষণাৎ অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তারপরও খণ্ডবিখণ্ড অবস্থায় ছদ্মবেশে বিভিন্ন জায়গায় শিব পঞ্চপাণ্ডবদের দর্শন দেন। কেদারনাথে ষাঁড়ের কুঁজ আবির্ভুত হয়। তুঙ্গনাথ-এ বাহুদ্বয়, রুদ্রনাথ-এ মস্তক, নাভি ও পেট আবির্ভূত হয় মদমহেশ্বর-এ, চুল ও জটা কল্পেশর-এ। এভাবেই খণ্ডিতভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল এই সকল জায়গায়। এরপর পাণ্ডব ভাইয়েরা এই পাঁচ জায়গাতেই শিবের মন্দির স্থাপন করলেন, যা এখন পঞ্চ কেদার নামে তীর্থস্থান হিসেবে সুপরিচিত। বহু যুগ যুগ ধরে এই সব মন্দির দর্শনের উদ্দেশ্যে মানুষের পদচারণা। এই ট্রেক রুটে গাড়োয়াল হিমালয়ের সবরকম প্রাকৃতিক বৈচিত্র ধরা পড়ে। তবে সব তীর্থস্থানগুলিই হাঁটা পথে যেতে হয়। বছরভর প্রচণ্ড শীত থাকার জন্য নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাসের নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মন্দিরগুলি বন্ধ থাকে।
কিভাবে যাবেনঃ
হাওড়া/কলকাতা থেকে ট্রেনে উত্তরাখণ্ডের হরিদ্বার/ঋষিকেশ/নাজিবাবাদ। তারপর সড়ক পথে পঞ্চ কেদারের প্রতিটির পৃথক প্রবেশ স্থানে পৌঁছে ট্রেক করে পৌঁছতে হয়। একনজরে দেখে নিন পঞ্চ কেদারের মন্দিরগুলি সম্পর্কে প্রাথমিক কিছু তথ্য।
কেদারনাথ মন্দির (উচ্চতা ১১৭৫৫ ফুট)
হিন্দুদের অন্যতম প্রধান ও জনপ্রিয় তীর্থস্থান। উত্তরাখণ্ড রাজ্যের গাড়োয়াল হিমালয় পর্বতশ্রেণীতে অবস্থিত কেদারনাথ শহরে মন্দাকিনী নদীর তীরে স্থাপিত একটি শিব মন্দির। এই অঞ্চলের প্রাচীন নাম ছিল কেদারখণ্ড। তাই এখানে শিবকে কেদারনাথ অর্থাৎ কেদারখণ্ডের অধিপতি নামে পূজা করা হয়।
তুঙ্গনাথ (উচ্চতা ১২০৭০ ফুট)
উত্তরাখণ্ড-এর রুদ্রপ্রয়াগ জেলায় অবস্থিত পৃথিবীর সর্বোচ্চ শিব মন্দির আর পঞ্চ কেদারের তৃতীয় কেদার। এখানকার মন্দিরে মহিষরূপী শিবের বাহু অংশটি আছে পাথরের আকারে।
মদমহেশ্বর (১১৪৫০ ফুট)
ধারাবাহিক সবুজের মাঝে পাহাড়ের কোলে মধ্য মহেশ্বর বা মদমহেশ্বর মন্দিরের অবস্থান। খুব ভোরে উঠে কিছুটা চড়াই ভেঙে পৌঁছে যান বুড়ো মদমহেশ্বেরের মন্দিরে। ঘাসে ঢাকা প্রান্তরের মাঝে ছোট্ট এক পাথুরে মন্দির। এখান থেকে চারপাশের দৃশ্য অপূর্ব। চৌখাম্বা ও মান্দানি শৃঙ্গমালাকে খুব কাছ থেকে দেখা যাবে। আছে এক ছোট্ট জলাশয়।
রুদ্রনাথ (৭৫০০ ফুট)
পাঁচটি কেদারের মধ্যে সবচেয়ে দুর্গম রুদ্রনাথ। নিস্তব্ধ, নির্জন পরিবেশে এ জায়গাটির আকর্ষণই আলাদা। সন্ধ্যার আরতি দর্শন নিশ্চিত আপনার বাকি জীবনের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ষাঁড়রূপী শিবের মস্তক অংশটি এখানে পূজিত হয়।
কল্পেশ্বর (৭২০০ ফুট)
কল্পগঙ্গা নদীর তীরে কল্পেশ্বর মন্দির। পাঁচটি কেদারের মধ্যে সবচেয়ে সহজ পথে পৌঁছানো যায়। নদীর বামতটে একটা হুমড়ি খাওয়া পাথরের নীচে অন্ধকারের মাঝে এই মন্দির। ষাঁড়রূপী মহাদেবের জটা অংশটি রয়েছে এখানে।
Photographer – কৌশিক ব্যানার্জী
Facebook Comments