গ্রাম্য পথ ধরে কিছুটা সমতলে গিয়েই চড়াই শুরু হল। কাঠের সাঁকো বেয়ে একটা ঝর্ণা পার করতেই জঙ্গল গ্রাস করলো আমাদের। আরও কিছুটা চড়াই ভাঙতেই একরাশ কুয়াশা ঘিরে ধরলো। যত এগোই গাঢ় হয় কুয়াশার চাদর। আরও খানিকটা এগিয়ে একটা ভিউপয়েন্ট। বিশ্রামের ফাঁকে অদৃশ্য হয় কুয়াশার দল। চোখে পড়ে আমাদের ফেলে আসা গ্রাম ইয়ুকসুম। যেন কোনও চিত্রকরের জলরঙে আঁকা ল্যান্ডস্কেপ।
আমরা এসেছি পশ্চিম সিকিমের অন্যতম জনপদ ইয়ুকসুম। যাঁরা পেলিং বেড়াতে আসেন তাঁদের কেউকেউ এখানে সাইটসিয়িং করে ফিরে যান। কিন্তু রাত্রিবাস না করলে এখানকার রূপ-রস-গন্ধ অনুভব করা যায় না। আমরা চলেছি গ্রাম ছড়িয়ে ঘন্টাখানেকের হাঁটাপথে সিকিমের প্রাচীনতম বৌদ্ধ গুম্ফা দর্শনে। কুয়াশার পর্দা সরে যেতেই জঙ্গলের গভীরতা অনুভূত হল, হারিয়ে গেলাম সবুজের মধ্যে। দূর থেকে গুম্ফার চূড়া নজরে পড়ল। পৌঁছে গেলাম দুবদি গুম্ফা। ফুলের বাগানে ঘেরা অনিন্দসুন্দর পরিবেশে এই গুম্ফার অবস্থান। ইতিউতি ঝোলানো প্রার্থনা-পতাকা। এক অদ্ভূত নির্জনতা আর নিস্তব্ধতা ছেয়ে আছে। দূর পাহাড়ের সীমারেখা মেঘে ঢাকা। ঝাপসা পাহাড়ের নিচ থেকে মেঘের দল সারি বেঁধে ওপরে উঠছে। দুবদি শব্দের অর্থ সন্ন্যাসী। এটি হল সন্ন্যাসী গুম্ফা। ১৭০১ সালে সিকিমের প্রথম চোগিয়াল অর্থাৎ রাজা রাজ্যাভিষেকের পর এই নির্জন স্থানে এই গুম্ফা নির্মাণ করেন।
দুবদি গুম্ফা দেখে আধঘন্টাটাক উৎরাই পথে হেঁটে ফিরে আসি ইয়ুকসুম। সবুজ পাহাড়ে ঘেরা ছোট্ট জনপদ। দূরে শ্বেতশুভ্র কাবুর শৃঙ্গ দৃশ্যমান। প্রধানত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষের আধিক্য এখানে। তাই সারাদিন হিমেল হাওয়ার সাথে ভেসে আসে প্রার্থনার সুর।
ইয়ুকসুম হল সিকিমের প্রথম রাজধানী। ১৬৪১ সালে তিব্বত থেকে আসা তিনজন বিদগ্ধ লামা সিকিম রাজ্যের প্রথম চোগিয়ালের রাজ্যাভিষেক ঘটান। তাঁর প্রমাণ সংরক্ষিত আছে অদূরের নরবুগাং চোর্তেনে। বড় পবিত্রস্থান এই ইয়ুকসুম। ইতিহাস আর প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার। রয়েছে পবিত্র এক জলাশয় কার্তক লেক। আরেকটু এগিয়ে গেলে একটা হেলিপ্যাড। পাহাড়ে ঘেরা অসাধারণ সুন্দর জায়গা। অনেকটা দূর দিয়ে কুলুকুলু শব্দে বয়ে চলেছে রাঠং নদী। দেখতে গেলে অনেকটা নামতে হয়। হেঁটে কিম্বা গাড়ি করে ঘুরে নিতে পারেন নরবুগাং চোর্তেন, কার্তক লেক আর হেলিপ্যাড।
আলাদা গাড়ি নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন কাঞ্চনজঙ্ঘা ফলস্ , রিম্বি ফলস্ , ফামরং ফলস্ আর সিকিমের আরেক অন্যতম পবিত্র আরেক জলাশয় খেচিপেরি লেক।
সবমিলিয়ে ৩/৪ দিনের ছোট্ট সফরে গেলে আপনাকে নিরাশ করবে না ইয়ুকসুম।
কিভাবে যাবেন:
কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি বা নিউ জলপাইগুড়ি। সেখান থেকে গাড়ি বুকিং করে ইয়ুকসুম।
কোথায় থাকবেন:
বেশ কয়েকটি হোটেল রয়েছে। অবস্থান এবং দাম অনুযায়ী নির্বাচন করে নিন।
সেরা মরসুম:
বর্ষার সময়টুকু ছাড়া বছরের যে যেকোনও সময় যেতে পারেন।
Photographer – Kaushik Banerjee
Facebook Comments