কলেজ জীবন পেরিয়ে সবে উড়তে শিখেছি৷ ক্লাসমেট মৈনাক উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারের এক হোস্টেলে ডাক্তারি পড়ার জন্য শহরবাসী৷ মাঝেমধ্যেই ওর হোস্টেলে হানা দিতাম৷ গল্পগুজব, আড্ডা, কলকাতায় সিনেমা – থিয়েটার দেখা, এসবের জন্য মৈনাকের হোস্টেলই তখন ভরসা৷ তখন কলকাতায় রাত্রিবাসের একমাত্র আস্তানা৷ বেশ কয়েকবার থাকার সুবাদে ওর সহপাঠী বন্ধুরা এখন আমারও বন্ধু হয়ে উঠেছে৷ টিউশনির টাকায় হাতখরচ সামলে শখ-আহলাদ মেটাতে হয়, বেড়ানোর নেশা তখনও গ্রাস করেনি৷ মোবাইল ফোন দূর অস্ত, নিজের ক্যামেরাই ছিল না৷ হঠাৎ একদিন দু’জনে ঠিক করে ফেললাম বেড়াতে যাব, সুন্দরবন৷ কিছুই চিনি না, নিজেদের বেড়ানোর অভিজ্ঞতাও নেই, সুন্দরবনের শুধু নামটাই জানতাম৷ ম্যাগাজিন ঘেঁটে ট্যুর-প্ল্যান করে ফেলা হল৷
সালটা সম্ভবত ১৯৯৮, সেটা ছিল জুনের শেষ৷ বর্ষা বেশ ঘটা করেই এসে গেছে৷ বইটই ঘেঁটে মৈনাকই জায়গার সুলুক-সন্ধান করলো৷ বাবুঘাট থেকে বাসে সোনাখালি, সেখান থেকে ভুটভুটি নৌকায় বাসন্তী হয়ে গোসাবা, তারপর সাইকেল ভ্যানে চেপে পাখিরালা গ্রাম হয়ে সজনেখালি দ্বীপ ! রাস্তার ফিরিস্তি শুনে তো চক্ষু চড়কগাছ ! পৌঁছাবো কখন !
হোস্টেল থেকে সক্কাল সক্কাল দুগ্গা দুগ্গা বলে দু’জনে বাবুঘাটে হাজির হলাম৷ গিয়েই শুনি সোনাখালির বাস এই মুহূর্তে নেই, ফিরতি বাস এলে তবেই পাওয়া যাবে৷ খুবই হতাশ হয়ে গেলাম৷ আধঘন্টাটাক অপেক্ষা করেও যখন কোন লাভ হল না, তখন চটজলদি সিদ্ধান্ত নিলাম বিকল্প রুটের৷ যদিও সেটা আরও ঝক্কির৷ শিয়ালদা স্টেশনে গিয়ে ক্যানিং লোকালে চড়লাম৷ ভিড়েঠাসা ট্রেনে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কোনক্রমে দুটো বসার সিট পেলাম৷ হরেক হকারের হৈচৈ ! মুখরোচক নানান খাবার, এগুলো দিয়েই ব্রেকফাস্ট সারা হল৷ প্রথমবার এরকম অভিভাবকহীন ট্যুরে বেড়ানো, একটা অজানা আশঙ্কা তাড়া করে বেড়াচ্ছে৷ এ যেন স্বাবলম্বী হওয়ার পরীক্ষা ! উত্তীর্ণ না হলেই যেন বাড়ি ফিরে তিরস্কার জুটবে ! ঘন্টাদেড়েক ট্রেনে চেপে ক্যানিং পৌঁছে সাইকেল ভ্যানে ডকঘাট অর্থাৎ ফেরিঘাট গেলাম৷ গিয়েই আবার অবাক হওয়ার পালা৷ নদী পারাপার করতে গিয়ে দেখি প্রায় মাঝনদী পর্যন্ত চড়া পড়েছে ! ভাটা চলছে তাই কাদা মাড়িয়েই নৌকায় উঠতে হবে৷ অগত্যা পালিশ করা বুটজুতো হাতে নিয়ে প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে কোনমতে টাল সামলে নৌকায় উঠলাম৷ আমরা কাদায় নামলাম, আর জামা- প্যান্ট ঘটা করে ইস্ত্রি করার পয়সাটা জলেই গেল ! উপায়ই বা কি !
নদী পেরিয়ে এবার অটো চেপে সোনাখালি৷ সূর্যদেব তখন মধ্যগগনে, আমাদের পেটে ছুঁচোর কেত্তন ! মাছ – ভাত দিয়ে মধ্যাহ্নভোজন সেরে আবার ভুটভুটি নৌকায়৷ সহযাত্রীরা সকলেই স্থানীয়৷ সঙ্গে কারও সাইকেল, বাজারের বস্তা, এমনকি পোষ্য ছাগলও আমাদের সফরসঙ্গী ! অফ্সিজন, তাই কোন ট্যুরিস্ট নেই, এই ঘোর বর্ষায় আসবেই বা কে ! আমাদের দু’জনকে এই অসময়ে যেতে দেখে সবাই অবাক ! এই বর্ষায় সুন্দরবন !
নদীতে এখন ভরা জোয়ার৷ দূরে দিগন্তের সবুজ ক্ষীণরেখা সুবিশাল আকাশ আর বিস্তৃত জলরাশিকে আলাদা করেছে৷ নদীর তীরে নৌকার অপেক্ষায় যাত্রীরা৷ মাঝেমাঝেই ছোট্ট ছোট্ট ঘাটে নৌকো নোঙর করছে, আর যাত্রীরা ওঠানামা করছেন৷ আজ সকাল থেকে আর বৃষ্টি হয়নি৷ সূর্য সারাদিন মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে ক্লান্ত হয়ে দিগন্তের কোলে ক্রমশ ঢলে পড়ছে৷ আমাদের মনে চাপা টেনশন শুরু হলো কখন পৌঁছাবো, কোথায় থাকবো, কি খাবো ? সন্ধ্যা নামার আগে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে না পেলে কি হবে ? অচেনা – অজানা জায়গায় অসময়ে এসে কি বিপদ ডেকে আনলাম ?
(ক্রমশঃ)
ছবি সৌজন্যে – কৌশিক ব্যানার্জী
Facebook Comments