কাজ করতেন মনে রাখার মত। তাঁর কাজের জগতে তিনি শুধু শেফ ছিলেন না, কারও কাছে দাদা, কারও কাছে বন্ধু, আবার কারও কাছে ইন্সপিরেশন। জীবন চলছিল নিজের গতিতেই। হাতের জাদুতে মুগ্ধ ভোজনরসিক থেকে শুরু করে কাছের মানুষেরা। সব সময়ই মাথায় ঘুরত নতুন কি তৈরী করা যায়! শুধু শেফ নন বাবা, এবং স্বামী হিসেবে তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ মানুষ। তিনি ছিলেন একজন ভালোবাসার মানুষ। ভালোবাসা ছিল সকলের জন্য। বিয়ে করেছিলেন ভালোবেসে। স্ত্রী সুকল্পা বললেন, “প্রায় ২৮ বছরের সম্পর্ক। ছিল বলব না, যতদিন আমি আছি সেই সম্পর্কের বয়স বাড়বে। আজ ছেলে ১১ বছর। এতদিনের সম্পর্ক তাতে ভালো, খারাপ সব থেকে। কিন্তু ও এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি আদতে একজন নরম মানুষ। লাভ ম্যারেজ আমাদের। একই পাড়ায় থাকতাম। পরিচয় সেখানেই। কথা বলতে ভালো লাগত। বন্ধুত্ব হল। প্রায় ৪ বছর পর দুজনেই বুঝতে পারলাম একে অপরের অনেকটা কাছে চলে এসেছি। একে অপরকে ছেড়ে থাকা সম্ভব নয়। বুঝতে পারলাম ভালোবেসে ফেলেছি।” এই ভাবে শুরু তাদের জার্নি। ভাবছেন উনি কে? শেফ “সুবীর সরকার”। এই নামটাই তাঁর পরিচয়ের জন্য যথেষ্ট। এই জার্নি হঠাৎ করেই থেমে যায়। আজ সেই মানুষটার জন্মদিন। কে বলেছে শেফ সুবীর আর নেই? তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা যায়, এই তো পাশেই আছেন তিনি।
শেফ সুমন্ত চক্রবর্তী– কাজের সূত্রেই পরিচয় ছিল শেফ সুবীরের সঙ্গে। খুব বেশিদিন যে দেখা হয়েছে, একসঙ্গে যে প্রচুর কাজ করেছি এমনটা নয়। একবার এক ইভেন্টে একসঙ্গে দেখা। ওর সঙ্গে কাজ নিয়ে কথা হয়েছিল। ঐ সময় কথা বলে বুঝেছি ওর মধ্যে সবসময় নতুন কিছু করার তাগিদ থাকত। সবসময় ওর মন কাজের মধ্যেই থাকত। যেটুকু সময় দেখা হয়েছিল তার মধ্যে যে বেশীর ভাগটা কাজ নিয়েই কথা হয়। কথা বলে বোঝা গিয়েছিল ভীষণ নরম একজন মানুষ। কাল সুবীরের জন্মদিন। ভগবানের কাছে একটা জিনিসই চাইব ও যেখানেই আছে ভালো থাকুক।
শেফ স্বরূপ চ্যাটার্জী– শেফ সুবীর আমার কাছে দাদা, বন্ধু, শিক্ষক। প্রায় ৭ বছর একসঙ্গে কাটিয়েছি। কাজ করতে গিয়ে বহু মানুষের কাছে অনেক কিছু শিখেছি। সেই রকম ভাবেই শেফ সুবীর-এর কাছেও অনেক কিছু শিখেছি। বলা যায় আমি ওনাকে নকল করতাম। ওনার মত মানুষ খুব কম আছেন। উনি এমন একজন শেফ ছিলেন যাকে কোন কিছুতে আটকানো যেত না। সব দিকেই উনি তার বেস্ট দিতেন। আজও যখন আমি নতুন কিছু করি ভাবি শেফ সুবীর এখানে থাকলে কি করে করতেন। শেফ সুবীর ছিলেন স্পষ্ট বক্তা। সেই কারণেই অনেক সময় অনেকের কাছে খারাপ হয়ে যেতেন। পড়ে হয়ত ভুল বুঝতে পেরে তারা কাছে টেনে নিতেন শেফ সুবীরকে। অবাক লাগে ভাবতে সুবীর দাকে আর দেখতে পাবো না। শেফ সুবীর আজও আছেন পরেও থাকবেন। শুধু ভালো থাকুন।
শেফ দামোদর বেহড়া– আমি আর সুবীর একসঙ্গে বহুদিন কাজ করেছি। হাতে করে অনেক কিছু শিখিয়েছি। সব সময়ই মনে হত সুবীর অনেক বড় জায়গায় যাবে। ওর জন্য অনেক কিছু অপেক্ষা করছে। কিন্তু কে জানত এমন কিছু অপেক্ষা করছে! যার জন্য ছিল বিশাল জগৎ, নিজের তৈরী খাবার, প্রচুর লোকের ভালোবাসা, তার সঙ্গে এমন কিছু কি করে হয়! এটাতো ওর প্রাপ্য ছিল না। যাই হোক, সুবীর ভালো থাকুক। ও আমাদের সঙ্গে সব সময় আছে।
রাজদীপ ভট্টাচার্য– কাজের সূত্রে অনেকের সঙ্গে পরিচয়। সেইরকম ভাবেই শেফ সুবীরের সঙ্গে পরিচয়। আগের বছর এক ইভেন্টে দুজনের দেখা। ছাদাখ হাই নামে এক ইভেন্ট হয় যেখানে দুজনেই জাজমেন্ট দিতে যাই। অনেকটা সময় একসঙ্গে কাটিয়েছিলাম। বেহালা নেচার পার্কে ছিল এই অনুষ্ঠান। তারপরেই ঘটে সেই ঘটনাটা। জানতাম না ওটাই আমার আর শেফ সুবীরের শেষ দেখা। সেফ সুবীর এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি নতুন নতুন ভাবে কত কি যে তৈরী করত তা ভাবাই যায় না। ইলিশ মাছ যে বাঙালি ডিশ ছাড়াও আরও কিছু ভাবে তৈরী করা যায় তা শেফ সুবীর শিখিয়েছিলেন।
শেফ ইন্দ্রজিৎ রায়– কোনদিন ভাবিনি এইভাবে কিছু বলতে হবে। শেফ সুবীরের মত এত শান্ত, নরম করে কথা বলার মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। যে যেই সমস্যায় পড়ুক শেফ সুবীর সবসময় পাশে আছেন। যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন শেফ সুবীর।
সনিয়া রায়– শেফ সুবীর, এই নামটাই যথেষ্ট তার ইমেজ মাথায় আনতে। আদ্যপ্রান্ত ভদ্র মানুষ। ওনার সঙ্গে কাজ করতে পেরেছি অনেকদিন। যেটা শিখেছি তা হল ভালো মানুষ হতে। হয়ত অনেক লোকের আয়োজন হল হঠাৎ করে, কি করব! একটাই ভরসা, শেফ সুবীর। শান্ত ভাবে সবটা হাতের মুঠোয় নিয়ে আসতেন তিনি। আজও উনি আছেন মনে মনে। যেখানেই থাকুন শান্তিতে থাকুন।
শেফ দেবাশীষ রায়– একসাথে চলার পথ শুরু করেছিলাম। শেফ সুবীর আর মানুষ সুবীর দুজনই অসাধারণ মানুষ। কয়েকটা ঘটনা বলি। তখন দুজনই একই জায়গায় শেফ। সেই সময় একটা জিনিসের খুব চল হয়েছিল, বরফের তৈরী স্কাল্পচার। মানে তা বরফের গণেশ হতে পারে, বরফের পাখী হতে পারে। হঠাৎ মালিক বললেন সেরকম একটা স্কাল্পচার তৈরী করতে। আমি তো জানিনা করতে। কি করবো ভাবছি, এমন সময় সুবীর এসে বলল আমি খুব একটা ভালো পারিনা, কিন্তু চেষ্টা করতে পারি, চলো শিখিয়ে দিই। এই যে এগিয়ে এসে দায়িত্ব নেওয়া। এটা কেউ বোধহয় এখন কেউ করেনা। এতো গেল শেফ সুবীর। মানুষ সুবীর কেমন ছিলেন? সময়টা অনেক আগের। দুজন ঠিক করলাম চাকরি করব, ফর্ম ফিলাপ করলাম চাকরির। ইন্টারভিউয়ের ডাক এল, তড়িঘড়ি ছুটলাম বোম্বের টিকিট কাটতে। একজন বলল 500 টাকা দাও, টিকিট কনফার্ম হয়ে যাবে। সাতপাঁচ না ভেবে দিয়ে দিলাম। আর স্বাভাবিক ভাবেই পরে বুঝলাম আমরা ঠকেছি। ট্রেনে উঠে কোন মতে টিটিকে বলে একটা মাত্র সিট পেলাম। কিন্তু দুজন বড় মানুষ কি ভাবে একটা সিটে এতবড় রাস্তা কাটাতে পারে। শেফ সুবীর এসে বললেন তুমি উপরে শুয়ে পরো আমি নিচে যাচ্ছি। এই যে নিজের কথা না ভেবে এতবড় কথা বলেছিলেন, এই রকম ভাবে এখন আর কেউ বলবে না। ও চলে যাওয়ার কয়েক মাস আগেও কথা হয়েছে। কোনোদিনের জন্য একবারও জানতে দেয়নি, এইরকম ভাবে ও ভুগছে। নিজের মধ্যেই লুকিয়ে রেখেছিল ওর যন্ত্রনা।
শখ ছিল বাগান করার। নিজের বাড়িতেই সাজিয়ে তুলেছিল গাছ, ফুলে। ঘুরতে যেতে খুব ভালোবাসতেন তিনি। আর নিজের রান্না করে ছবি তুলে রাখতেন সে গুলোর। ফুটবলের ভক্ত ছিলেন সুবীর।
ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন শেফ সুবীর। স্ত্রী সুকল্পা নিজের হাতে সাজিয়ে তুলেছিলেন সংসার। নিজের হাতেই রান্না করে খাওয়াতেন শেফ সুবীরকে। যেই মানুষটির হাতের রান্নার জন্য অপেক্ষা করতেন বহু খাদ্যরসিক। সেই মানুষটি ভালোবাসতেন বাড়ির খাবার খেতে। স্ত্রীর হাতে মোচার কোফতা খেতে ভালোবাসতেন খুব। চলে যাওয়ার কয়েকদিন আগেও স্ত্রীর কাছে খেতে চান মোচার কোফতা। তারপরেই এল সেই দিন হারিয়ে গেলেন তিনি। তাকে খুঁজলেও আর পাওয়া যাবে না বড় রেস্টুরেন্টের কিচেনে নতুন কিছু করতে। আর পাওয়া যাবে না তাঁর হাতের যাদু। বাকি থেকে গেল অনেক কিছু। আফসোস রয়ে গেল সঙ্গীদের।
Facebook Comments