দ্বিতীয় পর্ব
সকলে উঠে ফাইনাল প্যাকিং সেরে বেরোতে একটু দেরিই হয়ে গেল। হিলেতে এই গেস্ট হাউসটি ছাড়াও রাত্রিবাসের জন্য বনদপ্তরের কাঠের বাংলো আর একটি প্রাইভেট হোটেল রয়েছে। এখানকার বাসিন্দারা প্রায় সকলেই বনদপ্তরের কাজের সঙ্গে যুক্ত। সকাল থেকেই আজ আকাশের মুখ ভার। কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা মিলল না।
পিচঢালা রাস্তা ছাড়িয়ে সিঁড়ি ভেঙে একটু উঠেই ছোট্ট একটি তোরণ। বার্সে রডোডেনড্রন স্যাঙ্কচুয়ারির প্রবেশপথ। বনদপ্তরের অফিস। নাম নথিভূক্ত করে, অনুমতিপত্র নিয়ে, ক্যামেরার জন্য নির্দিষ্ট চার্জ জমা দিয়ে ট্রেক শুরু হল। তোরণ পেরিয়ে ঢুকে পড়লাম সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্কের গহন অন্তরালে। বনদপ্তরের সাইনবোর্ডে লেখা এই অঞ্চল পশু-পাখিদের অবাধ বিচরণভূমি। বন্য শূকর, বার্কিং ডিয়ার, রেড পাণ্ডা, ব্ল্যাক বিয়ার এইসব প্রাণীদের দেখার সৌভাগ্য হতে পারে। এছাড়া অসংখ্য প্রজাতির পাখির দেখা মেলে এখানে। বেশকিছু দুর্লভ প্রজাতির পাখিও রয়েছে এই অঞ্চলে। তাই পক্ষীপ্রেমীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় এই সিঙ্গালিলা জাতীয় উদ্যান। চারিদিকে ওক, পাইন, বাঁশগাছের ঝোপ আর রডোডেনড্রন গাছের মেলা। প্রায় সবরকম প্রজাতির রডোডেনড্রন এখানে দেখতে পাওয়া যায়। মার্চ-এপ্রিলে রঙবেরঙের রডোডেনড্রন ফুলের মেলা বসে। রডোডেনড্রন ছাড়াও হেমলক, ম্যাগনোলিয়া সহ বিভিন্ন অর্কিডের দেখা মেলে এই অঞ্চলে।
কোথাও সমতল কোথাও হালকা চড়াই ভেঙে একটা কৃত্রিম জলাধারের কাছে পৌঁছে যাই। তাকে বামহাতে রেখে আরও কিছুটা এগিয়ে পৌঁছে যাই বার্সের সবুজ আঙিনায়। এখানকার উচ্চতা প্রায় ১০হাজার ফুট। হিলে থেকে সাড়ে ৪কিমি পথ পার হয়ে কোলাহলহীন পরিবেশে অপূর্ব এক বাংলোর সামনে এসে পড়ি। নাম গুরাসকুঞ্জ। রডোডেনড্রন ফুলকে স্থানীয়রা বলেন গুরাস। তাই এই নাম। সবুজ ঘাস দিয়ে তৈরি প্রাকৃতিক গালিচা। তার মধ্যে অবস্থান এই সুদৃশ্য বাংলোর। থাকা-খাওয়ার সুবন্দোবস্ত আছে। বহু পর্যটক এখানে এসে রাত্রিবাস করেন। আবহাওয়া পরিস্কার থাকলে সপারিষদ কাঞ্চনজঙ্ঘা শৃঙ্গ দেখার সৌভাগ্য হয়। এখন আকাশ মেঘে ঢাকা, আমরা তাই নিরাশ হলাম।
এই বার্সে থেকে একটি পথ ১০কিমি জঙ্গল উজিয়ে সোরেং চলে গেছে। সেখান থেকে ফেরার জন্য গাড়ি পাওয়া যায়। আমরা চা পানের বিরতি নিয়ে পশ্চিমদিকে এগিয়ে চলি। জঙ্গল গভীর থেকে ক্রমশ গভীরতর হয়। এবার শুধুই অ্যালপাইন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলা। রাস্তা প্রায় নেই বললেই চলে। ছোট বাঁশ আর কাঁটাগাছের ঝোপঝাড়ের মধ্যে পিঠের স্যাক আটকে যায়। নিস্তব্ধতায় গা ছমছম করে, এই বুঝি জংলী পশুর সম্মুখীন হলাম ! আমাদের গাইড মিংমা সকলকে একসঙ্গে হাঁটার পরামর্শ দিয়েছেন। দলছুট হয়ে পড়লেই বিপদ ঘটতে পারে। হিংস্র জন্তুর শিকার হওয়ার সম্ভাবনা। পথ খুব বেশি চড়াই-উৎরাই না হলেও রাস্তা না থাকায় ঝোপঝাড় পেরিয়ে হাঁটতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে। অরণ্যের ছায়াঘন পরিবেশে সবুজ প্রকৃতি ক্রমশ গাঢ়তর হয়ে উঠছে। কোথাও কোথাও সূর্যের আলোর প্রবেশে যেন নিষেধাজ্ঞা আছে। গাছের বয়সের যেন কোনও গাছপাথর নেই ! গুঁড়িতে বিভিন্ন রকম ছত্রাকের কারুকাজ। দিকবিদিক থেকে ভেসে আসছে বিচিত্র সব আওয়াজ। গাইড অভয় দেয়, ‘ভয় নেই, ওগুলো পাখির ডাক’!
অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি। প্রথমদিনের গন্তব্য এখনও অনেকটা দূর। তাই মাঝেমাঝে দলবদ্ধভাবে বিশ্রাম নেওয়া। পথচলতি পাহাড়ি ঝোরা থেকে পানীয় জল সংগ্রহ করতে হচ্ছে। জিওলিন মিশিয়ে পানের উপযুক্ত করে নিতে হচ্ছে। বিশ্রামের ফাঁকে প্রকৃতিকে ভাল করে চাক্ষুষ করে আবার এগিয়ে চলা।
বার্সে থেকে ঘন্টাদুয়েক হেঁটে ঘাস আর কাঁটাঝোপের একটা উপত্যকায় পৌঁছে যাই। গাইড জানায় জায়গার নাম লাসুনে। স্থানীয়রা এখানে গোচারণের উদ্দেশ্যে আসাযাওয়া করে। সহজপথে ওঠানামা করতে করতে দূর থেকে আমাদের টেন্টগুলো চোখে পড়ল। ঠিক যেন ফুলের মত ফুটে রয়েছে। আমাদের মালবাহী বন্ধুরা আগেই ওখানে পৌঁছে টেন্ট পিচ করে খাওয়াদাওয়ার বন্দোবস্ত শুরু করে দিয়েছে। পাহাড় ঘেরা বিস্তীর্ণ প্রান্তরে বিবর্ণ ঘাসে ঢাকা জমি পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম দেওনিঙ্গালি ধাপ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা প্রায় ১০৩০০ফুট। লাসুনে থেকে প্রায় ৪কিমি পথ, সময় লাগলো ঘন্টাদুয়েক। একটানা জঙ্গলপথ পেরিয়ে এসে খোলামেলা দেওনিঙ্গালি ধাপে পৌঁছে সকলের বেশ স্বস্তি লাগছে। আকাশ এখনও মেঘাচ্ছন্ন। আমাদের ‘ওয়েলকাম ড্রিংক’ চিকেন স্যুপ রেডিই ছিল। তারপর মুড়ি-চানাচুর খেয়ে ইতিউতি ঘুরে দেখার পালা। সূর্য পশ্চিম আকাশে মিলিয়ে যেতেই কনকনে ঠাণ্ডা জাঁকিয়ে বসলো। তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে স্লিপিং ব্যাগের সেঁধিয়ে গেলাম।
ছবিঃ কৌশিক ব্যানার্জী
ক্রমশঃ
Facebook Comments