ছিপছিপে পৌঁছতেই হঠাৎ করে হাওয়ার দাপট বেড়ে গেল। চড়াই ভেঙে উঠে আসা শরীরে জমে ওঠা ঘাম নিমেষে উধাও হয়ে কনকনে ঠাণ্ডায় একটা আরামের পরশ পেলাম। ক্ষণিক বিশ্রাম নিয়েই আবার পা বাড়ানো। চড়াইয়ের মাত্রা কিছুটা কমলেও শুরু হলো বরফের প্রকোপ। রাস্তার ওপর বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সন্তর্পনে বরফ এড়িয়ে এগিয়ে চলতে হচ্ছে। নাহলে পিচ্ছিল বরফে পতন অনিবার্য। বরফের মাত্রা ক্রমশ বাড়তে থাকে। হাঁটা পথ আরও কঠিন হয়ে ওঠে। এভাবেই পৌঁছে যাই খাড়কা দাড়া। উচ্চতা প্রায় ১১হাজার ফুট। এখানেও তাঁবু খাটিয়ে থাকা যায়। আমরা এগিয়ে চলি। বরফের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে হাওয়ার বেগ। ডানদিকে গভীর খাদ, বরফমাখা পাহাড়ের বিপজ্জনক ঢাল বেয়ে খুব সন্তর্পনে হেঁটে পৌঁছে যাই আমাদের আজকের গন্তব্য কালিঝার। উচ্চতা প্রায় সাড়ে ১১হাজার ফুট।
ঢেউখেলানো ঘাসে ঢাকা জমিতে ইতিউতি কাঁটাঝোপের জঙ্গল। চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে জমাটবাঁধা বরফের আস্তরণ। কালিঝারে জলের খুব অভাব, অনেকটা নিচে নেমে জলের উৎস। আমরা সেখানে পৌঁছানোর আগেই গাইডের সঙ্গীরা সেখানেও পৌঁছে যায়। পৌঁছে তাঁবু লাগিয়ে খাবারের বন্দোবস্ত শুরু করে দেয়। স্টোভ জ্বালিয়ে পড়ে থাকা বরফের চাঙড় ভেঙে সকলের রান্নার আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। বরফগলা জলেই স্যুপ বানিয়ে গলাধকরণ করা হলো। দিগন্তে তখন শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখরে পড়ন্ত সূর্যের আলো আবির মাখিয়ে দিচ্ছে। হাওয়ার দাপটে তাঁবুর বাইরে ঘোরাফেরা করা দায়। হিমশীতল হাওয়াকে উপেক্ষা করে অনিন্দ্যসুন্দর মুহূর্তের সাক্ষী হতে আমরা অপেক্ষমান। অবশেষে হাজির সেই কাঙ্খিত মুহূর্ত। উত্তর আকাশে কাঞ্চনজঙ্ঘাসহ অন্যান্য তুষারশৃঙ্গের মাথায় সোনালী রঙের আভা। শেষ সূর্যের আলোয় মাখামাখি হয়ে রাঙিয়ে ওঠা সেই দৃশ্য দেখার জন্য বহু পথ পাড়ি দেওয়া যায়। আকাশের ক্যানভাসে সেই রঙের খেলা স্মরণীয় হয়ে থাকবে বহুদিন।
সূর্যাস্তের পরে হাওয়া আর ঠাণ্ডার দাপট বেড়ে গেল। জবুথবু হয়ে টেন্টের মধ্যে সকলে মিলে বসে কফি আর পাকোড়া খেতে খেতে গল্পগুজব চললো বেশ কিছুক্ষণ। কিছু পরেই ডিনারের ডাকে বাইরে বেরোতেই আবার অবাক হওয়ার পালা। উপত্যকা তখন ভেসে গেছে প্রাক পূর্নিমার চাঁদের আলোয়। চন্দ্রালোকে উজ্জ্বল হয়ে তুষারশৃঙ্গ। পরিচ্ছন্ন আকাশে নক্ষত্রের মেলা। তুষারমন্ডিত পরিবেশে এ যেন ন্যাচারাল অ্যাম্পিথিয়েটার ! খিচুড়ি আর ডিমভাজা খেতে খেতে সেই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার মজাই আলাদা। এই জন্যই তো এত কষ্ট করে ট্রেকিংয়ে আসা ! হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডায় স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে ঢুকে কোনক্রমে রাতটা কাটালাম।
অন্ধকার থাকতেই গাইডের ডাকে সবার ঘুম ভাঙে। চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি টেন্টের আউটারে পাতলা বরফের আস্তরণ। এখান থেকে সামান্য চড়াই ভাঙলেই ফোকতে দাড়া ভিউপয়েন্ট। আমরা টেন্টের কাছেই সূর্যোদয়ের জন্য প্রতীক্ষা করতে থাকি। পূব আকাশে শুরু হয় রঙের খেলা। আকাশজুড়ে শ্বেতশুভ্র তুষারশ্রেণীর সীমাহীন সৌন্দর্য্য। ঘুমন্ত বুদ্ধের শান্ত, স্নিগ্ধ, মন্ত্রমুগ্ধ রূপ।
ক্রমশ….
ছবি সৌজন্যেঃ কৌশিক ব্যানার্জী
Facebook Comments