আজ ৮ মার্চ, বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে নারী দিবস। যদিও যেকোন প্রগতিশীল সমাজে নারীর দিন প্রতিদিন। নারী শুধু পরিবারের মেরুদন্ড নয়। নারী সহ্য, নারী ধৈর্য্য, নারী শক্তি, নারী বিনয়, নারী আশা, নারী আলো, নারী অনুপ্রেরণা। প্রতি বছরে আজকের এই দিনটিতে সবাই সোচ্চার হন। কোথাও সভা হয়, কোথাও হয় নানা বিধ সামাজিক অনুষ্ঠান, ফুল বিনিময়। এছাড়াও শ্রদ্ধা জানানো হয় মুখে মুখে। কিন্তু পরিবর্তন কি হয় তেমন কিছু? আজও বন্ধ হয়নি নারী ভ্রূণ হত্যা। বন্ধ হয়নি ছোট ছোট শখ থেকে বঞ্চিত করা। বয়েস বাড়ার সঙ্গে বাড়ে প্রতিবন্ধকতা। অথচ অন্যদিকে বাড়ির ছেলেটি! খানিকটা হলেও ইচ্ছে পূরণের ডিসকাউন্ট নিয়ে এই পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হয়। তারপর শুরু হয় নারীর বৈবাহিক জীবন। ইচ্ছা, আশা, আকাঙ্ক্ষা, ভালোলাগা কিংবা মন্দ লাগা তার সবকিছু পূরণের দড়ির লাগামটা থাকে কর্তার হাতে। বাপের বাড়ি তখন অথিতিয়ালয়। এটিই তথাকথিত উপমহাদেশের চিত্র। এইভাবে চলছে যুগের পর যুগ। তবে এই চালচিত্রকে স্বাভাবিক ভাবে নিচ্ছে অনেকে। তবে ব্যতিক্রমও আছে বৈকি।
কিন্তু প্রশ্ন… তাহলে আমাদের গন্তব্য কোথায়? নারীর উন্নতি কি তবে পথভ্রষ্ট হবে? আজ একাবিংশ শতাব্দিতে এসেও নারীরা সম্পদ না হয়ে বোঝা কি হিসেবে রয়েছে? এই অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে আমাদেরকেই। যদিও সঠিক এবং সুশিক্ষার অভাবে এখনও সমাজের বেশীরভাগ অংশে নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয়নি। রয়েছে প্রচুর হীনমন্যতা। আসেনি প্রকৃত স্বাধীনতা, তৈরি হয়নি সম্মান জনক অবস্থান। কিন্তু তৎসত্বেও আজকের নারী নানান প্রকারের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাজকর্মে তার দুঃসাহসিক ভুমিকার ছাপ রেখে অগ্রসর হয়ে চলেছেন। এই প্রসঙ্গে বলতে গেলে, অতি সম্প্রতি আমরা দেখেছি ২০২০এর বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউন চলাকালীন গোটা পৃথিবীকে একপ্রকার স্তব্ধ হয়ে যেতে, এইভাবেই কেটেছে বছরের শেষ দিন পর্যন্ত। এরপর নতুন বছর অর্থাৎ ২০২১ নিয়ে আসে নতুন সংকল্প। এই কর্মকান্ডে পিছিয়ে নেই নারীরাও। এবছরের নারীদিবসে তেমনি কিছু স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত নারীরা দূর্যোগ পরবর্তী কালে নিজেদের কর্মের উদ্যোগ ও সাফল্য নিয়ে কি ভাবছেন আসুন জেনে নিই তাদের থেকেই। আমরা প্রশ্ন করেছিলাম…….
👉🏽কোভিড পরবর্তী কালে বিভিন্ন সামাজিক ভুমিকায় নারীরা পুরুষদের সঙ্গে সমান নেতৃত্বে থাকতে কি করা উচিৎ বলে আপনি মনে করেন?
👉🏽প্রতিষ্ঠিত নারীরা কিভাবে সমাজের বিভিন্ন স্তরের পিছিয়ে পড়া নারীদের এগিয়ে আসতে সাহায্য করতে পারে?
পিছিয়ে পড়া নারীদেরকে তাদের দায়িত্ব, কর্তব্য ও প্রাপ্তির বিষয়ে সচেতন করতে হবে। এই সচেতন নারীদের নেতৃত্ব বিকাশের জন্য প্রতিষ্ঠিত নারীদের এগিয়ে আসতে হবে। এটা সরকারী, বেসরকারি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করা যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
ঘরে এবং বাইরে সমানভাবেই পুরুষদের সাথে নারীদের এগিয়ে যেতে হবে, যখনই ঘর থেকে বাইরে যাবে নিজে এবং পরিবারের সবাইকে পরিচ্ছন্নভাবে থাকার উপর, মাস্ক পরার উপর গুরুত্ব দিতে হবে। সমানভাবে কর্মক্ষেত্রে তার সহকর্মীরা অধীনস্তরা যেন পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। প্রয়োজনে পুরুষদের সাথে এলাকাভিত্তিক প্রচারণার ব্যবস্থা করতে হবে যেন তারা কোভিডের ব্যাপারে সবসময় সতর্ক থাকে।
প্রতিষ্ঠিত নারীরা সমাজের বিভিন্ন স্তরের পিছিয়ে পরা উন্নয়নকামী, উদ্যমী নারীদের আর্থিক মানষিক এবং সামাজিক নিরাপত্তা প্রদানের মাধ্যমে সাহায্য করতে পারে।
সাধারণ মানুষের জীবনে গণমাধ্যমের সরাসরি প্রভাব রয়েছে। সে অনলাইন মিডিয়া হোক বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া। সাংবাদিকতা বা মিডিয়া পেশায় এখনো পুরুষের আধিপত্য। বিভিন্ন নির্যাতনের বেশি শিকার হন নারী। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীর সংখ্যাও হাতে গোনা। তবে আগের তুলনায় নারী গণমাধ্যমে নারী সংখ্যা বেড়েছে। মিডিয়া ব্যক্তিত্ব পম্পি মুখার্জি কথা প্রসঙ্গে বললেন নারী বান্ধব কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করাসহ নিতে হবেকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ। নারীদের নিয়োগে গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারকদের মনমানসিকতায় পরিবর্তন এবং নারী সাংবাদিকদের যাতে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়, সে বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন।
বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুলের নাতনি খিলখিল কাজী তাঁর ভাষ্যমতে নারীদের উদ্যেশে কবির লেখায় উক্তিটি বলে তাঁর শুভেচ্ছা জানিয়েছেন
বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
এ-বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল,
নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু-গন্ধ সুনির্মল।
উত্তরে তিনি বলেন সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নারীদের উজ্জীবিত করা, সময়োপযোগী প্রশিক্ষণ প্রদান, লিংকেজ করে আত্মকর্মসংস্হানের ব্যবস্থা করা, দরিদ্র অসহায়দের সহযোগিতা করা, আগ্রহী ও উৎসাহীদের স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে কাজ করা, নারী সংগঠন তৈরি করে উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে সহায়তা করা। সর্বোপরি নৈতিক মূল্যবোধ ও দায়বদ্ধতার ক্ষেত্র থেকে দায়িত্ব পালন করা।
তিনি আরও বলেন সমাজের প্রতিষ্ঠিত নারীদের সহযোগিতা ও সহমর্মিতা দিয়ে পিছিয়ে পড়া নারীদের সাহায্য করতে পারেন। বিশেষ করে এলাকা ভিত্তিক নারীদের তালিকা তৈরি করে চাহিদা মোতাবেক প্রশিক্ষণ প্রদান এবং প্রয়োজনীয় ঋণের ব্যবস্থা করা, লিংকেজ স্হাপন, সচেতনতা তৈরি, নারী নির্যাতন বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সাহায্য করা যেতে পারে। মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত সচেতনতা বৃদ্ধি ও অধিকার সম্পর্কে জানানো তাহলেই পিছিয়ে পড়া নারীদের এগিয়ে নেওয়া সহজ হবে।
(১) নারী পুরুষদের সঙ্গে সমান নেতৃত্বে না থাকাটাই তো ভুল হবে। কোভিড চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে দুঃসময়ে মানুষের পাশে মানুষ দাঁড়াবে, ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে।
(২) শিক্ষা আর সুযোগ – আমরা প্রত্যেকে যারা সমাজে একটু হলেও প্রতিষ্ঠিত, তারা যদি একজনের দায়িত্ব নিতে পারে, তাহলেই কিন্তু আমরা অনেকদূর এগিয়ে যাবো। প্রতিষ্ঠিত এক নারী যদি আরেকজন নারীর সেই সুযোগ আর শিক্ষার ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে আমরা মেয়েরা অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারি।
(১) সামাজিক সব রকমের উদ্যোগে যে কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সকল নারী নেত্রীদের সচেতন ও দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
(২) সমাজের প্রতিষ্ঠিত নারীদের পিছিয়ে পরা নারীদের প্রতি সমব্যথী হয়ে তাদের সহযোগিতা করার মনোভাব গ্রহণ করতে হবে ও তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করতে হবে।
(১) মায়েদের মেয়ে সন্তানকে সন্তান হিসেবে দেখতে হবে। মেয়ে হিসেবে নয়। কোভিড পরবর্তীকালে বলে নয়। এটা শ্বাশত। কোভিড পুরুষদের অনেক সহানুভূতিশীল করেছে। মহিলাদের উচিত একে তাদের দুর্বলতা না ভাবা। তাহলেই সর্ব স্তরে বিকাশ হবে।
(২) নিজেদের অহং থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কে কি পরিবারে এবং কি পরিবেশে মানুষ হয়েছে, তাকে মান্যতা দিয়ে, তার লড়াকু মানসিকতাকে প্রাধান্য দিতে হবে। যতক্ষণ না দুজন পাশাপাশি বসার অনুমতি পাবে, ততক্ষণ সামাজিক বিকাশ ঘটবে না। নবজাগরণের উন্মোচন হবে না।
Facebook Comments